উপনিষৎ বলছেন—‘‘মন্ত্রাঃ মননাৎ’’ অর্থাৎ যার দ্বারা মনন (চিন্তন) করা যায় তাকে মন্ত্র বলে। মন্ত্র শব্দটিতে দুইটি ভাগ আছে যথা—‘মন্‌’ ও ‘এ’। মন্‌ শব্দটি ‘‘মনন্‌’’ অর্থক এবং ‘‘এ’’ শব্দটি ত্রাণবোধক। তজ্জন্য শাস্ত্র বলছেন—‘‘মননাৎ ত্রায়তে যস্মাত্তস্মান্মন্ত্রঃ প্রকীর্ত্তিতিঃ।’’ যার মনন দ্বারা বিশ্বজ্ঞান লাভ করা যায় এবং সংসার বন্ধন থেকে মুক্তি পাওয়া যায় তাকেই মন্ত্র বলা হয়। বস্তুতঃ মন্ত্র হচ্ছেন কতগুলি শব্দ-সমষ্টি যা বেদের অংশ। এই স্থানে কিছু প্রাসঙ্গিক বিষয় সম্বন্ধে অতি সংক্ষেপে বলা হচ্ছে সাধারণ পাঠকদের জন্য। বেদ—সৃষ্টির প্রারম্ভে পিতামহ পদ্মযোনি ব্রহ্মা ক্ষীর সমুদ্রে অনন্ত শয্যায় শায়িত ভগবান নারায়ণের নাভিদেশ উত্থিত কমলের উপর একা (একা, কারণ তখন আর কিছুই সৃষ্টি হয় নাই) উপবিষ্ট হয়ে বিহ্বল নেত্রে চতুর্দ্দিক দেখছিলেন। তখন, তিনি কে, কোথা থেকে এসেছেন, তাঁর করণীয় কি, এতৎ সমস্ত কিছুই তিনি অবগত ছিলেন না। এই সকল প্রশ্নের উত্তর দিবার নিমিত্ত কেউ ছিলেন না। উৎসুক মনে নিজ আসন, পদ্মটিকে দেখতে লাগলেন। তাঁর ইচ্ছা হলো সেই পদ্মটির উৎপত্তি স্থান জানবার। পদ্মনলীর মুখ দেখতে পেয়ে তিনি তখন তার মধ্যে প্রবেশ করতঃ নলীর ভিতরে নীচের দিকে যেতে লাগলেন। পরন্তু বহু সহস্র বৎসর ভ্রমণ করেও তিনি পদ্মটির উৎস  জানতে সমর্থ হলেন না। হতাশ হয়ে ব্রহ্মা পদ্মের উপর প্রত্যাবর্ত্তন করলেন। একাকী, নিঃসঙ্গ তিনি, কোন শিক্ষা দিবার কেউ নাই, চতুর্দ্দিক নিস্তব্ধ। নিজ বাক্‌যন্ত্র ব্যবহার দ্বারা কথা বলা যায়—সে শিক্ষা দিবারও কেউ নাই, অতএব তিনি নির্ব্বাক। এমন সময় সেই মহাসমুদ্রের উপরে স্থিত মহাশূন্যের নিস্তব্ধতা ভঙ্গ করে—‘‘তপ’’ এই অশরীরী বাণী গুঞ্জিত হলো বার কয়েক। ব্রহ্মা তখন ‘তপ’ শব্দটি চিন্তা করতে করতে আত্মজ্ঞানের ইচ্ছায় গভীর ধ্যানে নিমগ্ন হলেন। বহু শত বৎসর এইরূপ ধ্যানে অতিবাহিত হলো। যোগাসনে আসীন ধ্যান নিমীলিতনেত্র ব্রহ্মার হৃদয়ে এক সময় অস্ফুট নাদধ্বনি স্বরূপ প্রণব (ওঁকার তত্ত্ব) প্রকাশিত হলো। তারপর সেই প্রণব থেকে প্রকট হলো স্বরবর্ণ, ব্যঞ্জনবর্ণ সমুদয়। সেই বর্ণগুলির অবলম্বনে ব্রহ্মা শব্দরাশি উচ্চারণ করলেন। বস্তুতঃ শব্দসমূহ স্বয়ং ব্রহ্মার কণ্ঠ দ্বারা উচ্চারিত হলো। এইভাবে শ্রীভগবান স্বয়ং বাঙ্‌ময়ী মূর্ত্তি ধারণ করে অর্থাৎ শব্দরূপ গ্রহণ করে ব্রহ্মার কণ্ঠ দেশ থেকে আবির্ভূত হলেন। শ্রীভগবানের সেই বাঙ্‌ময়ী মূর্ত্তি বেদ নামে অভিহিত হয়েছেন। অর্থাৎ বেদ হলেন শ্রীভগবানের শব্দরূপী মূর্ত্তি যিনি শব্দব্রহ্ম নামেও জ্ঞাত। চক্ষুরিন্দ্রিয় দ্বারা যা আমরা গ্রহণ করি বা বুঝি তাকে বলা হয় রূপ। তদ্রূপ যা আমরা কর্ণেন্দ্রিয় দ্বারা গ্রহণ করি বা বুঝি তাকে বলা হয় শব্দ। ইন্দ্রিয়াতীত ব্রহ্মের প্রথম ইন্দ্রিয় গ্রাহ্য মূর্ত্তি (ইন্দ্রিয় দ্বারা গ্রহণযোগ্য মূর্ত্তি) হলেন—শব্দ। এই বেদ হলেন আদি গ্রন্থ। প্রতিকল্পের প্রারম্ভে অর্থাৎ সৃষ্টির পূর্ব্বে শ্রীভগবান প্রজাপতিরূপে স্বয়ং বেদের প্রকাশ ও প্রচার করে থাকেন। যেমন কোন ভাব ভাষাকে অবলম্বন করেই প্রকাশিত হয় তেমনই প্রতিকল্পের প্রারম্ভে, জগতাদি সৃষ্টির বহুপূর্ব্বে এই বেদের শব্দরাশি অবলম্বনে বৈদিক ভাবসমূহ (বেদে নিহিত ভাবরাশি) প্রকাশিত হয়েছেন এবং অদ্যবধি বর্ত্তমান আছেন।