একজন ব্যক্তিমানুষের হৃদয়ের যে-কামনা তা হলো, আধুনিক মনোবিজ্ঞানের মতে, আসলে একটা পূর্ণতাপ্রাপ্তির আকুতি। আমাদের প্রত্যেক কামনার পেছনে রয়েছে হৃদয়ের একটা শূন্যতা, যা পূর্ণতা লাভের জন্য ব্যাকুল। অতএব, প্রত্যেক কামনাই আমাদের হৃদয়ের কোন-না-কোন শূন্যতার ইঙ্গিতবাহী। ভেতরের এই শূন্যতাকে পূর্ণ করতে হলে বাইরে কোন কাজ করা দরকার। অতএব, প্রত্যেক কর্মের আগে দুটো স্তর আছে। প্রথমত, ভেতরে কোথাও একটা অভাববোধ আছে, এমন একটা আকুতি আছে যে সন্তুষ্ট হতে চায়। তারপর এই আকুতি রূপ নেয় কামনার—কামনা এমন কিছুর জন্য যা সেই কাঙ্ক্ষিত চরিতার্থতা এনে দিতে পারে। এবং শেষে, এই আকুতির সন্তোষ বিধানের জন্য আসে কর্ম। মনোবিজ্ঞান মানুষের মোটামুটি চোদ্দটি মৌলিক আকুতি বা স্পৃহার কথা বলে—যথা ক্ষুধা, কাম ইত্যাদি। উদাহরণ হিসেবে এর মধ্যে সবচেয়ে পরিচিতটিকে নেওয়া যেতে পারে—ক্ষুধা। এখানে আমরা তিনটি স্তর বা অবস্থা লক্ষ্য করব: ১) ভেতরের স্পৃহা ২) একটা বাহ্য বস্তু-কামনা ৩) সেই বস্তুটিকে পাবার জন্য প্রয়োজনীয় কর্ম। শেষের যে স্তর, অর্থাৎ কর্মের মধ্য দিয়ে ভেতরের স্পৃহা শেষ পর্যন্ত চরিতার্থতা পায়। যখন পেট ভর্তি থাকে তখন কোন ক্ষুধা থাকে না, খাবারের জন্য তখন কোন কামনা থাকে না এবং সেইজন্য ক্ষুধারূপ বাসনা, চরিতার্থ করার কোন কর্মপ্রয়াসও থাকে না। অতএব, কর্মের পূর্বশর্ত হলো দুটি—এক, ভেতরের আকুতি এবং দুই, তার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বাহ্যবস্তু পাবার কামনা। সেই আকুতি না থাকলে কোন কামনা থাকবে না এবং কর্মচেষ্টাও থাকবে না। 
আমাদের জীবন একটা অবিচ্ছিন্ন কর্মপ্রবাহ, কারণ আমাদের হৃদয় হলো আকুতি ও কামনা-বাসনার একটা আগ্নেয়গিরি। আপনি যদি অস্তিত্বের একটা অবস্থা কল্পনা করতে পারেন যেখানে এইসব কামনা-বাসনা নেই, তবে সেই অবস্থায় বাসনাতাড়িত কোন কর্মও থাকবে না। বেদান্ত একটা পূর্ণতার অবস্থার কথা বলেন, যেখানে অপ্রাপ্তির হাহাকার, কামনা ও কামনা-প্রসূত কর্ম অনুপস্থিত। 
এই কামনা শূন্যতা যাকে ‘অকামতা’ বলা হয়েছে, আসে ‘আত্মকামতা’ থেকে, যার অর্থ—আত্মার জন্য কামনা। যাতে আমরা এই অবস্থায় হৃদয়ের শূন্যতা এবং মৃত্যুকে গুলিয়ে না ফেলি, সেজন্য বেদান্ত এই অবস্থাকে বোঝাতে তৃতীয় একটি বিশেষত্বের কথা বলেন; তা হলো ‘আপ্তকামতা’, যার তাৎপর্য—অস্তিত্বের পূর্ণতা। বাসনাশূন্য সমাহিত মনের তুলনা করা হয়েছে সুন্দর বিশাল শান্ত জলাশয়ের সঙ্গে, যাতে একটিও অশান্তির ঢেউ নেই। জলাশয়ের সমাহিতভাব ভেঙে যায় যখন তাতে একটি পাথরের টুকরো ছুঁড়ে ফেলা হয়। তেমনি, আমাদের মনে যেসব কামনার উদ্রেক হয়, সেগুলি মানস সরোবরে তরঙ্গের সৃষ্টি করে।