যখন আমরা ভগবানকে ভালবাসি তখন যেন আমরা নিজেকে দু-ভাগ করে ফেলি—আমিই আমার অন্তরাত্মাকে ভালবাসি। ঈশ্বর আমাকে সৃষ্টি করেছেন আবার আমিও ঈশ্বরকে সৃষ্টি করেছি। আমরা ঈশ্বরকে আমাদের অনুরূপ ক’রে সৃষ্টি ক’রে থাকি। আমরাই ঈশ্বরকে আমাদের প্রভু হবার জন্য সৃষ্টি ক’রে থাকি, ঈশ্বর আমাদের তাঁর দাস করেননি। যখন আমরা জানতে পারি, আমরা ঈশ্বরের সঙ্গে এক, ঈশ্বর আমাদের সখা, তখনই প্রকৃত সাম্যবস্থা লাভ হয়, তখনই আমাদের মুক্তি হয়। সেই অনন্ত পুরুষ থেকে যতদিন তুমি আপনাকে এক চুলও তফাৎ করবে, ততদিন ভয় কখনও দূর হতে পারে না। ভগবৎ-সাধনা ক’রে—ভগবানকে ভালোবেসে জগতের কি কল্যাণ হবে?—বোকার মতো এই প্রশ্ন কখনও ক’রো না। চুলোয় যাক জগৎ, ভগবানকে ভালোবাসো—আর কিছু চেও না। ভালোবাসো এবং অপর কিছু প্রত্যাশা ক’রো না। ভালোবাসো—আর সব মত-মতান্তর ভুলে যাও। প্রেমের পেয়ালা পান ক’রে পাগল হ’য়ে যাও। বলো, ‘হে প্রভু, আমি তোমারই—চিরকালের জন্য তোমারই,—এবং আর সব ভুলে গিয়ে ঝাঁপ দাও।’ ‘ঈশ্বর’ বলতে যে ‘প্রেম’ ছাড়া আর কিছুই বুঝায় না। একটা বিড়াল তার বাচ্চাদের ভালোবেসে আদর করছে দেখে সেইখানে দাঁড়িয়ে যাও, আর ভগবানের উপাসনা কর। সেই স্থানে ভগবানের আবির্ভাব হয়েছে। এটা অক্ষরে অক্ষরে সত্য, এ-কথা বিশ্বাস কর। সর্বদা বলো, ‘আমি তোমার আমি তোমার, কারণ আমরা সর্বত্র ভগবানকে দর্শন করতে পারি। তাঁকে কোথাও খুঁজে বেড়িও না—তিনি তো প্রত্যক্ষ রয়েছেন, তাঁকে শুধু দেখে যাও। সেই বিশ্বাত্মা, জগজ্জ্যোতিঃ প্রভু সর্বদা তোমাদের রক্ষা করুন।’
নির্গুণ পরব্রহ্মকে উপাসনা করা যেতে পারে না, সুতরাং আমাদিগকে আমাদেরই মতো প্রকৃতিসম্পন্ন তাঁর প্রকাশ-বিশেষকে উপাসনা করতেই হবে। যীশু আমাদের মতো মনুষ্যপ্রকৃতিসম্পন্ন ছিলেন—তিনি ‘খ্রীষ্ট’ হয়েছিলেন। আমরাও তাঁর মতো খ্রীষ্ট হ’তে পারি, আর আমাদের তা হতেই হবে। খ্রীষ্ট ও বুদ্ধ অবস্থা-বিশেষের নাম—যা আমাদের লাভ করতে হবে। যীশু ও গৌতমের মধ্যে সেই সেই অবস্থা প্রকাশ পেয়েছিল। জগন্মাতা বা আদ্যাশক্তিই ব্রহ্মের প্রথম ও সর্বশ্রেষ্ঠ প্রকাশ—তারপর খ্রীষ্ট ও বুদ্ধগণ তাঁর থেকে প্রকাশ হয়েছেন। আমরাই আমাদের পারিপার্শ্বিক অবস্থা গঠন ক’রে নিজেদের বন্ধ করি, আবার আমরাই ঐ শিকল ছিঁড়ে মুক্ত হই। আত্মা অভয়স্বরূপ। আমরা যখন আমাদের আত্মার বাইরে অবস্থিত ঈশ্বরের উপাসনা করি, তখন ভালই ক’রে থাকি তবে আমরা যে কি করছি, তা জানি না। আমরা যখন আত্মার স্বরূপ জানতে পারি, তখনই ঐ রহস্য বুঝি। একত্বই প্রেমের সর্বশ্রেষ্ঠ অভিব্যক্তি।
স্বামী বিবেকানন্দের ‘দেববাণী’ থেকে