বাধা ও অসফলতার জন্য চিন্তা। মানসিক টানাপোড়েনের মধ্যে কোনও ভালো যোগাযোগ পেতে পারেন। ... বিশদ
বন্ধন বলিয়া যাহাকে বলা হয়, সেই বন্ধনের স্বরূপ কি? সেই বন্ধন কোথা হইতে আসিল? ইহা থাকে কি প্রকারে? ইহা হইতে মুক্তিরই বা কি উপায়? অনাত্মাই বা কি বস্তু? আর আত্মার স্বরূপই বা কী? এই অনাত্মা ও আত্মার পার্থক্যজ্ঞান কোন্ উপায়ে লাভ করা যায়?—আমাকে এই প্রশ্নসমুদায়ের উত্তর দয়া করিয়া দিন।
গুরু বলিলেন: হে শিষ্য, তুমি ধন্য—তুমি কৃতার্থ। তুমি তোমার বংশকে পবিত্র করিলে। অবিদ্যাবন্ধন হইতে মুক্ত হইয়া ব্রহ্মস্বরূপ-উপলব্ধির ইচ্ছা হইতে তুমি ধন্য হইলে।
পুত্রাদি পিতাকে ঋণ হইতে মুক্ত করিতে পারেন। কিন্তু অবিদ্যাবন্ধন হইতে মুক্তিদানের কর্তা নিজে ছাড়া আর কেহই নাই।
মাথার উপর স্থাপিত বোঝা হইতে যে কষ্ট হয়, সে কষ্ট অপরে দূর করিতে পারে। কিন্তু নিজের ক্ষুধাতৃষ্ণার জ্বালা নিজের চেষ্টা ছাড়া অপরের দ্বারা নিবারিত হয় না। (অপরে খাইলে আমার ক্ষুধাতৃষ্ণা মেটে না।)
যে রোগী নিয়মিতভাবে ঔষধসেবন ও সুপথ্যগ্রহণ করেন, তাঁহার আরোগ্যলাভ হইয়া থাকে। অপর কেহ ঔষধ-পথ্যাদি গ্রহণ করিলে রোগী নিরাময় হয় না। আত্মার স্বরূপ নিজের সংশয়বিপর্যয়রহিত জ্ঞানের দ্বারা অনুভব করিতে হইবে। অপরে (জ্ঞানী গুরু) জানিলে তাঁহার জ্ঞানের ফলে মুমুক্ষুর কি লাভ হইবে? (গুরুর জ্ঞানের ফলে শিষ্যের স্বরূপের বোধ জন্মিবে না)। চাঁদ কেমন জানিতে হইলে নিজের চক্ষু দ্বারা দেখিয়াই জানিতে হইবে। অপরে বহু চক্ষু দ্বারা দেখিলেও আমার কাছে তাহাদের দেখার কী মূল্য, যদি আমি নিজের চক্ষু দ্বারা না দেখি?
নিজের প্রযত্ন ছাড়া অবিদ্যা, কাম ও কর্মের বন্ধন হইতে মুক্ত হইতে শতকোটিকল্পেও আর কে সমর্থ হয়? (অর্থাৎ অপর কেহ মুক্তি দিতে পারে না। মুক্তির জন্য নিজেকেই সাধনা করিতে হইবে)।
অষ্টাঙ্গযোগ, প্রকৃতি-পুরুষের তত্ত্ববিচার, বৈদিক যজ্ঞাদি বা দানাদি কর্ম, শাস্ত্রপাঠজনিত জ্ঞান, এসকলের কোনটির বা সকলগুলির দ্বারা মোক্ষলাভ ঘটে না। মোক্ষলাভের আর কোন উপায়ও নাই। একমাত্র ব্রহ্মের সহিত আত্মার অভেদজ্ঞান হইতে মোক্ষপ্রাপ্তির ঘটে।
বীণার সৌন্দর্যে বা উহা বাজাইবার নৈপুণ্যে শ্রোতাদের আনন্দ উৎপাদনমাত্র হইতে পারে। ঐসকল দ্বারা সাম্রাজ্যলাভ হয় না।
ভাষার উপর অধিকার, শব্দপ্রয়োগে নৈপুণ্য, শাস্ত্রব্যাখ্যায় চাতুর্য, আর কাব্য-অলঙ্কারাদিতে পাণ্ডিত্য, বিদ্বান্ ব্যক্তিগণের ভোগ্যবস্তুপ্রাপ্তির সহায়ক হইতে পারে। এসকল কিন্তু মুক্তিলাভের সহায়তা করে না।
আত্মস্বরূপ অবিজ্ঞাত থাকিলে শাস্ত্রপাঠ নিষ্ফল হয়। আর আত্মস্বরূপ বিজ্ঞাত হওয়ার পর শাস্ত্রাধ্যয়ন নিষ্প্রয়োজন হইয়া পড়ে।
শাস্ত্রপাঠের দ্বারা ব্রহ্মবিষয়ে অপ্রত্যক্ষ জ্ঞান হইতে পারে। কিন্তু শাস্ত্রপাঠের দ্বারা জ্ঞাত তত্ত্ব যদি জীবনে অনুভূত না হয়, ব্রহ্মের সহিত একাত্মবোধ না জন্মে, তাহা হইলে শাস্ত্রপাঠ ব্যর্থ হইয়া যায়। আর যে সাধক ব্রহ্মস্বরূপ অনুভব করিয়াছেন, তাঁহার শাস্ত্রপাঠের প্রয়োজন থাকে না।
মহাবনের সদৃশ বিভিন্ন শাস্ত্রসমুদায় চিত্তে সংশয় উৎপাদনের কারণ হইয়া থাকে। অতএব বিচারশীল ব্যক্তিগণ যত্নের সহিত শ্রবণমননাদি সহায়ে আত্মার স্বরূপ অবগত হইবেন। অজ্ঞানরূপ সর্পের দ্বারা আহত ব্যক্তির বেদপাঠে বা শাস্ত্রপাঠে কী ফললাভ হয়? আর মন্ত্র বা ঔষধের দ্বারাই বা তাহার কী উপকার হয়? একমাত্র ব্রহ্মজ্ঞানরূপ ঔষধের দ্বারা তাহার মরণের হাত হইতে মুক্তিলাভ সম্ভব। ঔষধ পান না করিয়া কেবল ‘ঔষধ’-শব্দ উচ্চারণ করিলে রোগ সারে না। অপরোক্ষানুভূতি ব্যতীত কেবল ‘ব্রহ্ম’-শব্দের উচ্চারণের দ্বারা মুক্তিলাভ হয় না।
শঙ্করাচার্যের ‘বিবেকচূড়ামণি’ স্বামী বেদান্তানন্দের (অনূদিত)