বাধা ও অসফলতার জন্য চিন্তা। মানসিক টানাপোড়েনের মধ্যে কোনও ভালো যোগাযোগ পেতে পারেন। ... বিশদ
“চিত্রজল্প” কথাটি আচার্য্যপাদগণের একটি পরিভাষা। পরিভাষাটির তাৎপর্য্য অনুভব করিতে হইলে আচার্য্যপাদগণের আস্বাদিত রসতত্ব সম্বন্ধে কিঞ্চিৎ আলোচনা প্রয়োজন। তাহাই পূর্ব্বাহ্নে করা যাইতেছে।
গৌরীয় বৈষ্ণবাচায্যগণের অনুভবে জগতের পরতত্ত্ব প্রেম। প্রেম হইতেই জগতের উৎপত্তি— প্রেমেই স্থিতি— প্রেমেই পরিণতি। শ্রুতিমন্ত্রে রহিয়াছে জগৎ আসিয়াছে আনন্দ হইতে জগৎ চলিতেছে আনন্দের অভিমুখে। বেদ তাই আনন্দকেই ব্রহ্ম বলিয়াছেন। “আনন্দং ব্রহ্ম”। গৌড়ীয় আচার্য্যগণের মতে আনন্দের পরাকাষ্ঠাই “প্রেমপদবাচ্য” “আনন্দ চিন্ময় রস প্রেমের আখ্যান।” প্রেমের অভিব্যক্তি প্রেমিক-প্রেমিকার ভাব-বন্ধনের মধ্যে।
“যদ্ভাববন্ধনং যূনোর্বুধৈঃ প্রেমা নিগদ্যতে।” (শ্রীরূপ)
যে ভাব-বন্ধন অনিত্য, তাহা প্রেম নহে। যে ভাব-বন্ধন অজর, অমর, অবিনাশী তাহাই প্রেম। ধ্বংস হইবার সর্ব্ববিধ কারণ রহিয়াছে তথাপি ধ্বংস হয় না যে ভাব-বন্ধন, তাহাই প্রেম। “সর্বথা ধ্বংসরহিতং সত্যপি ধ্বংসকারণে।” এই ভক্ত-ভগবানের ভাব-বন্ধনই প্রেমপদবাচ্য হইতে পারে। লৌকিক কোন সম্বন্ধই ঐ পদের বাচ্য হইতে পারে না।
ইক্ষুরস গাঢ় হইলে গুড় হয়। গুড় গাঢ় হইলে চিনি হয়। চিনি গাঢ় হইলে মিছরি হয়। মিছরি গাঢ় হইলে সিতামিছরি, খণ্ডমিছরি হয়। সেইরূপ প্রেমবস্তু ক্রমশঃ গাঢ়তাপ্রাপ্ত হইতে হইতে— স্নেহ-মান- প্রণয়, রাগ- অনুরাগ, ভাব- মহাভাব, রূঢ়- মহাভাব, অধিরূঢ়- মহাভাব ও মাদনাখ্য- মহাভাবে পরিণত হয়। স্তরগুলির সংক্ষিপ্ত পরিচয় এইরূপ—
প্রেম যখন গাঢ়তর হয় তখন চিত্তরূপ দীপকে উদ্দীপ্ত করে “চিদ্দীপদীপনন্” এবং হৃদয়কে দ্রবীভূত করে “হৃদয়ং দ্রাবয়ন্” তখন তাহার নাম “স্নেহ”। অন্তরে স্নেহ জন্মিলে কৃষ্ণের রূপ দর্শনে কখনও নয়নের তৃপ্তি হয় না।
“কোটি আঁখি নাহি দিল সবে দিল দুই।
তাহাতে নিমেষ দিল কি দেখিব মুই।”
স্নেহের উদয় হইলে কৃষ্ণকথা শ্রবণে কর্ণের কিছুতেই তৃপ্তি হয় না। আরও শুনিতে সাধ হয়। কৃষ্ণনাম জপ করিতে রসনার তৃপ্তি হয় না পুনঃ পুনঃ উচ্চারণ করিতে ইচ্ছা হয়।
“না জানি কতেক মধু, শ্যাম নামে আছে গো,
বদন ছাড়িতে নাহি পারে।”
এখানে প্রেম, স্নেহে পরিণত হইয়াছে। স্নেহ দুই প্রকার। ঘৃতস্নেহ ও মধুস্নেহ। ঘৃতস্নেহ শ্রীকৃষ্ণের আদরে কৃতার্থ হইয়া যেন বিগলিত হইয়া যায়। মধুস্নেহ কৃষ্ণের আদরে গাঢ়তাপ্রাপ্ত হইয়া দৃঢ়তর হয়। তাহাতে কৃষ্ণের সুখাতিশয্য হয়। ঘৃতস্নেহ স্বয়ং আস্বাদ্য নহে, অন্যের সঙ্গে মিলিত হইলে আস্বাদ্য। মধুস্নেহ স্বয়ংও আস্বাদ্য, অন্যের সঙ্গে মিলনেও আস্বাদ্য।
মধুস্নেহ উৎকৃষ্টতা প্রাপ্ত হইলে নবতর মাধুর্য্যের উদয় হয়। তখন তাহা কি যেন কি এক অদ্ভুত উপায়ে অতি প্রিয় প্রেমাস্পদের প্রতি অদাক্ষিণ্যভাব ধারণ করে। তখন তাহার নাম “মান”। মানে কৃষ্ণের অত্যাদরেও উপেক্ষা দৃষ্ট হয়। শেষে তীব্র বিরহদশা উদিত হয়।
“কাঁদিয়া কহয়ে পুনঃ ধিক্ মোর বুদ্ধি।
অভিমানে হারাইলাম কানুগুণনিধি।।”
মান গাঢ়তাপ্রাপ্ত হইয়া যখন বিশ্রম্ভ রূপ ধারণ করে তখন তাহাকে বলে “প্রণয়”। বিশ্রম্ভ শব্দের অর্থ অভিন্নমনন। নিজ দেহ প্রাণ বুদ্ধির সহিত কৃষ্ণের দেহ মন প্রাণ বুদ্ধির অভিন্নতা মনে হয়। তখন প্রেমের নাম প্রণয়। প্রগাঢ় প্রণয়ে শ্রীকৃষ্ণের সঙ্গে দেহপ্রাণ-মনের ঐক্যভাবনাহেতু শ্রীরাধার বাহিরে
“নীলিম মৃগমদে, তনু অনুলেপন,
নীলিম হার উজোর।
নীল বলয় সনে, ভুজযুগ বন্ধন,
পরিহণ নীলনিচোল।।”
এই প্রণয় গাঢ়তর হইলে তাহার নাম হয় “রাগ।।” অন্তরে রাগের উদয় হইলে প্রিয়তমের জন্য অতিশয় দুঃখও সুখ বলিয়া মনে হয়।
“তোমার লাগিয়া কলঙ্কের হার,
গলায় পরিতে সুখ।”
রাগের গাঢ়তর অবস্থার নাম “অনুরাগ।” তখন নিত্যনবায়মান প্রিয়কে নব-নব ভাবে আস্বাদনে সাধ জাগে, কেবল সাধ জাগে না—সামর্থ্যের উদয় হয়। “সোই পিরীতি, অনুরাগ বাখানিতে, তিলে তিলে নূতন হোয়।” শ্রীকৃষ্ণের সৌন্দর্য্য যে কৃষ্ণেই আছে তাহা নহে। অনুরাগী ভক্তের নয়নের উপর উহা নির্ভরশীল। যেমন অনুরাগ বাড়ে, তেমন সৌন্দর্য্য বাড়ে।
“আমার মাধুর্য্য নিত্য নব নব হয়।
স্ব স্ব প্রেম অনুরূপ ভক্ত আস্বাদয়।”
অনুরাগদশায় আর একটি ঘটে অভিনব ব্যাপার। প্রিয়সঙ্গে মিলনকালে এক কল্পুকে এক ক্ষণ বলিয়া মনে হয়। “গত যামিনী জিত দামিনী।” ব্রহ্মরাত্রি ব্যাপিয়া রাসলীলা হইল, গোপীদের মনে হইল বিদ্যুতের মত রাত্রিটা আসিল আর চলিয়া গেল। আবার তদ্বিপরীত, প্রিয়ের বিরহকালে এ কক্ষণার্দ্ধকে যুগশত বলিয়া মনে হত। “যুগায়িতং নিমিষেণ।” আর একটি অদ্ভুত ব্যাপার হয় অনুরাগ দশায়-যাহাতে কৃষ্ণের সুখ হয় তাহাতেও গোপীকার অনিষ্ট আশঙ্কা জাগে। রাসরজনীতে বিরহিণীরা বিলাপ করিতে করিতে বলিয়াছেন—
আমাদের কর্কশ স্তনের উপর কৃষ্ণ, তোমার কোমল চরণকমল রাখিলে পাছে তুমি ব্যথা অনুভব কর এই ভয়ে “ভীতাঃ শনৈঃ দধীমহি কর্কশেষু” কত সন্তর্পণে ধীরে বুকের উপর চরণপদ্ম রাখি। আর সেই চরণে তুমি বিচরণ করিতেছ বনে বনে—যেখানে আছে কত শীলতৃণাঙ্কুর। একথা ভাবিতে মস্তক ঘূর্ণিত হইতেছে। তবে কি আমাদের কঠিন বক্ষস্পর্শে কৃষ্ণের চরণতল কঠিন হইয়াছে? –অথবা কোমল চরণস্পর্শে বনপথের পাথরখণ্ডগুলি কোমল হইয়া গিয়াছে!—এই সকল ভাবনা অনুরাগবতীর লক্ষণ।
অনুরাগ যখন “স্বসংবেদ্যদশা” প্রাপ্ত হইয়া “যাবদাশ্রয়বৃত্ত” হয় তখন তাহাকে ‘ভাব’ বলে। অনুরাগ এমন এক অনির্বচনীয় পরাকাষ্ঠা প্রাপ্ত হয়, যাহা কেবল নিজের অনুভবের বিষয়—তাই বলিয়াছেন স্বসংবেদ্য দশা। আর যতখনি উৎপন্ন হওয়া সম্ভব সবখানি একই সময় হইলে যাবদাশ্রয়বৃত্তি।