পুরনো রোগ চাগাড় দেওয়ায় দেহকষ্ট ভোগ করতে হতে পারে। তীর্থ ভ্রমণ ও ধর্মকর্মে আত্মিক তৃপ্তিলাভ। ... বিশদ
জনম দুখিনী সীতা। রাজর্ষি জনকের দুহিতা, স্বয়ং ভগবান শ্রীরামচন্দ্রের সহধর্মিণী জগজ্জননী সীতা। অথচ কি ক্লেশ, কি বিড়ম্বনাই না সইলেন সারা জীবন। বনে গমন, অপহরণ, লাঞ্ছনা, রাম বিরহ, সবই সহ্য করলেন নীরবে। কিন্তু তারপরও যখন বহু বৎসর পরে ফিরে এলেন অযোধ্যায়, তখন নিষ্করুণ মানুষ তাঁকে মিথ্যা কলঙ্ক দিতে দ্বিধা করেনি। চিরবিরহিণী রাধা। জটিলা কুটিলার জ্বালা সইলেন যে শ্যামসঙ্গসুখ আশায়, সেই নিঠুর কৃষ্ণ বৃন্দাবনকে কান্নার যমুনায় ডুবিয়ে চলে গেলেন বাঁশী ভেঙ্গে। অশ্রুর মালা শুকালো রাধিকার পূজার থালায়। শুধু বুকের গোপনে প্রেমপ্রদীপেজ্বলেছে বিরহের অনির্বাণ শিখা। কৃষ্ণচৈতন্য শ্রীগৌরাঙ্গের লীলাসঙ্গিনীর ভাগ্যেও ঘটেছে একই বিড়ম্বনা। জগৎ কল্যাণকল্পে মহাপ্রভু ত্যাগ করলেন সতী-সাধ্বী চিরপবিত্র বিষ্ণুপ্রিয়াকে। তখনই কিশোরী তপস্বিনী একান্তে মগ্ন হলেন বিরহ সাধনায়। চরম কঠোরতার মাঝে কেটে গেল দেবজীবন।
সেই একই সত্তার পুনঃ প্রকাশই তো বিশ্বমাতৃকার সারদার রূপে। সেবার বহুদিন পর পিতৃগৃহ থেকে মা এসেছে দক্ষিণেশ্বর, জননী শ্যামার সঙ্গে। তীরে তরী ভিড়তেই, ক্রোধান্ধ হৃদয়বাম তীব্র অপমান ভরা কঠোর স্বরে চীৎকার করে ওঠেন—‘কেন এলে তোমরা, কীসের জন্য এসেছ? এখনি চলে যাও।’ মেয়ের হাত ধরে কেঁদে ওঠেন শ্যামাসুন্দরী আর মায়ের অবস্থা? “যেন বেগ প্রতিহত তরঙ্গিনী—উপরে নিবিড় আকুলতায় নিথর একটি চরণ, নীচে কূল-চুম্বিত জলতট স্পর্শ করে মূক স্তম্ভিত আর এক চরণ। কবির ভাষায়—শৈলাধিরাজ তনয়া ন যযৌ ন তস্থৌ।”—(জননী সারদেশ্বরী) বিড়ম্বনার ব্যথা ভরা বুক চাপা অভিমান নিয়ে ফিরে গেলেন জয়রামবাটী।
সেদিনের সমাজ সঙ্কীর্ণতায় অন্ধ। জয়রামবাটী আর কামারপুকুর সেদিন মেনে নেয়নি মায়ের জাতিধর্মনির্বিশেষে পরম উদার স্নেহ ভালবাসার বিতরণ। কথায় কথায় তাঁকে করেছে জাতিচ্যুত, শাস্তি হয়েছে এক ঘরে করে দাও, অথবা দুশ’ একশ’ জরিমানা। অনেক জরমানা দিয়েছেন, সয়েছেন অনেক গঞ্জনা, অনেক অপবাদ। যাকে স্নেহ দিয়ে আদর যত্নের স্নেহ দিয়ে আদর যত্নের চূড়ান্ত করে পালন করেছেন সেই রাধুর অত্যাচারেরও শেষ নেই। মায়ের পিঠে বড় একটা বেগুনই ছুড়ে মেরেছে রেগে। আর পাগলী মামীর অত্যাচারও সয়েছেন অনেক। ঠাকুর তো বলেই খালাস—“আমার পরে তুমি শাক বুনবে আর খাবে।” ঐ দুর্দিনে বাবুর খাজাঞ্চি মাত্র সাত টাকা মাসোহারাও বন্ধ করে দিল। বিবেকানন্দ ব্যস্ত ছিলেন, কিন্তু মা নির্বিকার চিত্তে বললেন—“অমন সোনার ঠাকুরই চলে গেলেন, টাকা নিয়ে কি হবে!” মানুষের কাছ হতে যত আঘাতই এসেছে, যত কষ্টই এসেছে তিনি দেননি অভিশাপ বরং প্রার্থনা করেছেন তাদের কুশলের জন্য; তিনি যে সবারই মা। শ্রীরামকৃষ্ণ বললেন—‘আমি কি করেছি, এর চেয়ে অনেক বেশী তোমাকে করতে হবে।’ শত দুঃখ সয়ে করে গেলেন তিলে তিলে জ্বলে যাওয়ার অখণ্ড পঞ্চতপা—পরিবর্তে কোনও চাওয়া নেই নিজের সুখের জন্য।