পুরনো রোগ চাগাড় দেওয়ায় দেহকষ্ট ভোগ করতে হতে পারে। তীর্থ ভ্রমণ ও ধর্মকর্মে আত্মিক তৃপ্তিলাভ। ... বিশদ
বলিবার কথা আমার অনেক আছে। এত আছে যে, কণ্ঠ বাহিয়া বাহিরিবার জন্য তাহারা বিষম ঠেলাঠেলি লাগাইয়া দিয়াছে। তাহাতে আমার বুকের মধ্যে অসহনীয় উত্তাপ ও বেদনার সৃষ্টি হইয়াছে। কারণ, আমার যে শুধু একটা বই দুইটী কণ্ঠ নাই! সব কথা বলিবার জন্য যে শত শত কণ্ঠ চাই,—যে কণ্ঠে বজ্র ও বীণা একত্রে গর্জন-ঝঙ্কারে মুখরিত হইয়া উঠে, তেমন সহস্র কণ্ঠ চাই। আজ তোমাকে কোন্ কথা আমি বলিব? চারিদিকে খোলা চোখে চাহিয়া দেখ, খোলা কাণ পাতিয়া শুন, সকলে আজ কি বলিতে চাহিতেছে। আজ খোলা চোখে চাহিতে পারিলে আমার মুখের কথা না শুনিয়াও তুমি আমার মরমের কথা বুঝিতে পারিতে। ঐ যে বিশীর্ণ-কঙ্কাল আমারই শতকোটি ভাই-বোন, ঐ যে ক্ষুৎ-পিপাসা-পীড়িত আমারই লক্ষ কোটি আপনার জন, উহাদের মুখপানে তাকাইয়া দেখ, বুঝিবার মত দরদ থাকিলে অনায়াসে আমার কথা বুঝিবে। দিবা-অবসানে অন্ধকার যেমন স্বতঃসিদ্ধ, উহাদের মুখেও বেদনার আর্ত্তি, পীড়নের হতাশা তেমনই সুব্যক্ত। উহাদের দেখিয়া যদি তুমি উহাদের কথা বুঝিতে পার, যদি প্রাণের সমগ্রটুকু দিয়া উহাকে ধারণ করিতে পার, তবে আমি চুপ করিয়া বসিয়া থাকিলেও আমার কথা বুঝিবে। নতুবা রয়টারের তারে তারে পৃথিবী ঢাকিয়া ফেলিলেও উহা তোমার নিকট অবোধ্যই রহিবে। দীনদুঃখীর মর্ম্মবেদনা যদি আমার কথায় তোমার হৃদয়ে জাগিয়ে উঠে, অত্যাচারিতের আর্ত্তধ্বনি যদি আমার কণ্ঠে পরিস্ফুট হইয়া তোমার শ্রবণে ধ্বনিয়া উঠে, তবেই উহা প্রকৃত আমার কথা হইবে।
তুমি তোমার কাছেও আমার কথা জিজ্ঞাসা করিও। আয়নায় মুখ দেখিয়া মুখের উপরে আমার কথা পাঠ করিও। যদি আমার কথা শুনিতে চাও, তবে তোমার কথা শুনিতে চাহিও। আজ তোমরা আত্মস্থ হও, আজ তোমরা নিজের পানে তাকাও আর পরের পানে ফিরিয়া চাও, পরের দুঃখ দূর করিতে বিপদ-সাগরে ঝাঁপাইয়া পড়। তোমাদের কর্ম্ম, তোমাদের জ্বলন্ত আত্মত্যাগ যেদিন মুখর হইয়া উঠিতে শিখিবে, সেদিন আর আমি আমার শতকণ্ঠ নাই বলিয়া দুঃখ করিব না। শুধু মন দিয়া চাহিলে চলিবে না, প্রাণ দিয়া চাওয়া চাই। প্রাণ দিয়া চাহিলেই চাইবার মত চাওয়া হয়, সুতরাং পাইবার মত পাওয়াও হয়। মন দিয়া চাহিয়া ক্ষণভঙ্গুর স্মৃতিশেষ কল্যাণকে পাইতে পার, স্মৃতির সম্ভাব্যতা-বিহীন নিত্যপ্রত্যক্ষ অচলপ্রকাশ পরমানন্দকে লাভ করিতে পার না। তাই তোমাকে প্রাণ দিয়া চাহিতে হইবে। প্রাণ দিয়া চাহিতে পারিলে বিশ্বজগৎ তোমার সাথে ঐকতান-বদ্ধ হইয়া পরম প্রার্থনীয়কে তোমার জন্য চাহিবে।
যখন তুমি প্রাণ দিয়া চাহিবে, বিশ্বপ্রাণ তখন টলিবে। নিজেকে যতই কেন পৃথক করিয়া আজ ভাব না লক্ষ্মী, জগতের একটা তুচ্ছাতিতুচ্ছ অণুপরমাণুকেও ছাড়া তুমি নও, তোমাকে ছাড়াও উহাদের কাহারও অস্তিত্ব নাই। আর, প্রাণ অনংশ, অখন্ড ও অব্যর্থ। তাই প্রাণের সাধনা কখনও যুক্তিতর্কে খন্ডিত হইতে পারে না, ব্যাখ্যায় ব্যর্থ হয় না।