বিদ্যার্থীদের উচ্চবিদ্যার ক্ষেত্রে মধ্যম ফল আশা করা যায়, প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার ক্ষেত্রে সাফল্য আসবে। ব্যবসাতে যুক্ত ... বিশদ
শক্তিবাদ তন্ত্রবিজ্ঞানের বিরাট দান। দার্শনিক দ্বৈতবাদ বা অদ্বৈতবাদের মত শক্তিবাদ একটা মতবাদ নহে। কারণ, ইহা বৈজ্ঞানিক ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত। দার্শনিক মতবাদের ভিত্তি তর্ক, বিচার ও শাস্ত্রীয় প্রমাণ। বৈজ্ঞানিক মতবাদের ভিত্তি পরীক্ষিত সত্য (experimental truth)। অনুভূতি দুই প্রকার—ব্যক্তিগত অনুভূতি ও সর্ব্বজনীন অনুভূতি। কোন বিশেষ ব্যক্তির নিজস্ব অনুভূতির সত্যতা প্রতিষ্ঠিত করিতে বিচার, তর্ক ও যুক্তির প্রয়োজন হয়। যাহা সর্ব্বজনীন তাহা ব্যক্তিনিরপেক্ষ, অন্য প্রমাণের অপেক্ষা স্বতঃপ্রমাণ বলিয়া উহা অখণ্ডনীয়। শক্তিবাদ অনুরূপ একটি অখণ্ডনীয় সিদ্ধান্ত।
শক্তিবাদের প্রথম সিদ্ধান্ত শক্তি আছে। ইহা সকলের অনুভববেদ্য। ব্রহ্ম, আত্মা বা ঈশ্বর আছেন ইহা সাধারণের অনুভবের অতীত, যুক্তিতর্কের দ্বারা স্থাপন করিতে হয়—তীক্ষ্ণতর যুক্তির দ্বারা আবার উহা খণ্ডিতও হইতে পারে। শক্তিবাদ সেরূপ নহে, ইহা অখণ্ডনীয়। শক্তি নাই বলিবার সামর্থ্য কাহারও নাই। শক্তি অস্বীকার করিতেও শক্তির প্রয়োজন। শক্তিবাদ খণ্ডন করিতে বুদ্ধিশক্তি, বিচারশক্তি, বাক্শক্তির দ্বারস্থ হইতে হইবে। ভগবান্ আছেন আপত্তি হইতে পারে, শক্তি আছে ইহাতে আপত্তি করা যায় না। সুতরাং দেখা যাইতেছে যে, শক্তিবাদ খণ্ডন করিতে গিয়া যে-বস্তুর আশ্রয় লইতে হইতেছে তাহাও শক্তি। অতএব উহার অস্তিত্ব অনস্বীকার্য্য।
শক্তি আছে, ইহা শক্তিবাদের চরম কথা নহে। শক্তিবাদের অন্তরের কথা, একমাত্র শক্তিই আছে, নিখিল বিশ্বে শক্তি ছাড়া আর কিছুই নাই। জগতের প্রত্যেক বস্তুই শক্তির সমবায় (Conglomeration of energy) বস্তুমাত্রই শক্তি ভিন্ন আর কিছু নহে। এক একটি বস্তু, শক্তির এক এক ধরণের প্রকাশ। ‘যা দেবী সর্ব্বভূতেষু শক্তিরূপেণ সংস্থিতা’—দেবী মহাশক্তি সর্ব্বভূতে শক্তিরূপেই বিরাজিতা— ইহাই তন্ত্রের মহতী ঘোষণা। পাশ্চাত্ত্য বিজ্ঞানের সহিত তন্ত্রের এই সিদ্ধান্তের সাদৃশ্য বিস্ময়কর বলিলেও অত্যুক্তি হয় না। নিউটন সাহেবের সময় হইতে তিনশত বর্ষের জয়যাত্রার মধ্য দিয়া আজ বৈজ্ঞানিকেরা যে সিদ্ধান্তে পৌঁছিয়াছেন, উহা একান্তভাবে তন্ত্রের এই সিদ্ধান্তকে সমর্থন করে। পারমাণবিক আবিষ্ক্রিয়ার ফলে একটি সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম পরমাণুর মধ্যে যে প্রচণ্ড শক্তির খেলা প্রত্যক্ষ করা যায় তাহাতে বস্তু (matter) সম্বন্ধে আমাদের ধারণার আমূল পরিবর্ত্তন সাধিত হইয়াছে। বস্তুমাত্রই যে শক্তির সমবায় উহাতে এখন আর কাহারও সংশয় নাই।
শক্তিবাদের তৃতীয় কথা, সর্ব্বভূতে অর্থাৎ এই নিখিল বিশ্বচরাচরে একটিমাত্র শক্তিই আছে। বহু যে দেখি—তাপ (heat), আলো (light), বৈদ্যুতিক শক্তি (electricity)—উহা দৃষ্টির ভ্রমবশতঃই। বৈজ্ঞানিক দৃষ্টি লইয়া দেখিলে সবই একই শক্তির অভিব্যক্তি বলিয়া জ্ঞান হয়। কিছুদিন পূর্ব্বেও পরমাণু (atom) জগতের মূল কারণ— বিজ্ঞানের এইরূপ সিদ্ধান্ত ছিল। কিন্তু আজ এই মতের পরিবর্ত্তন হইয়াছে। সকল বস্তুই যে এক শক্তির পরিণতি, ইহা এখন সর্ব্ববাদিসম্মত বৈজ্ঞানিক সিদ্ধান্ত। আলো, তাপ, বিদ্যুৎ প্রভৃতির মূলে যে একটি মাত্র শক্তি বিদ্যমান, ইহা আজ বিশেষভাবে প্রমাণিত হইয়াছে। বহুকালের গবেষণার পর পাশ্চাত্ত্য-বিজ্ঞান আজ যে সিদ্ধান্তে পৌঁছিয়াছে—বিশ্বের মূলে একই শক্তি কাজ করিতেছে, ইহা ভারতীয় তন্ত্রশাস্ত্রী বহু পূর্ব্বেই দ্বিধাহীনকণ্ঠে ঘোষণা করিয়াছে।
পাশ্চাত্ত্য-বৈজ্ঞানিকগণ আজ শক্তিকে স্বীকার করিয়াছেন, সেই হেতু তাঁহাদের শাক্ত আখ্যা দেওয়া যায় না। শক্তি মানিলেই শাক্ত হয় না, শক্তির পূজারী হওয়া চাই। ভারতবর্ষে শক্তির যেরূপ পূজা হয়, পাশ্চাত্ত্যদেশে তদ্রূপ হয় না।
মহানামব্রত ব্রহ্মচারীর ‘চণ্ডী চিন্তা’ থেকে