বিদ্যায় সাফল্যও হতাশা দুই বর্তমান। নতুন প্রেমের সম্পর্ক গড়ে উঠবে। কর্মপ্রার্থীদের শুভ যোগ আছে। কর্মক্ষেত্রের ... বিশদ
প্রণবের ত্রিমাত্রার এক একটিকে যাঁহারা পৃথক্ পৃথক্ ভাবে উপাসনা করেন তাঁহারা লাভ করেন অপর ব্রহ্মকে—ইহা মৃত্যুর অধীন। কেবল ‘অ’কার মাত্রার উপাসকবৃন্দ পার্থিব লোক প্রাপ্ত হইয়া তপস্যা, ব্রহ্মচর্য্য ও শুদ্ধাভাবিত জীবনে মহিমা অনুভব করেন, কেবল ‘উ’কার মাত্রার উপাসকগণ লাভ করেন চন্দ্রলোক, ঐশ্বর্য্যভোগের পর যেখান হইতে তাঁহাদের পুনরাবর্ত্তন হয় এই পৃথিবীতে। খণ্ডিত ভাবে প্রণবমন্ত্রের উপাসনার ফল এইরূপেই। কিন্তু যিনি অখণ্ড ভাবে অ+উ+ম—এই ত্রিমাত্রক প্রণবের উপাসক, তিনি প্রাপ্ত হন তেজোময় সূর্য্যলোক। সর্পের জীর্ণ নির্ম্মোক ত্যাগের ন্যায় তিনি সর্ব্ব পাপ হইতে মুক্ত হইয়া ব্রহ্মলোকে উন্নীত হন এবং পরম পুরুষের দর্শন লাভ করেন। শান্ত, অজর, অভয়, সর্ব্বোত্তম পর ব্রহ্মকেই তিনি পান।
মাণ্ডুক্যোপনিষদের উক্তি—“পাদা মাত্রাঃ, মাত্রাশ্চ পাদাঃ”; পাদই মাত্রা, এবং মাত্রাই পাদ। ব্রহ্ম এবং প্রণবের একাত্মতা প্রদর্শনের প্রয়োজনেই এবম্বিধা উক্তি। ব্রহ্মের পাদসমূহই প্রণবের মাত্রা এবং প্রণবের মাত্রাসমূহই ব্রহ্মের পাদ। জাগ্রৎ, স্বপ্ন ও সুষুপ্তি—ব্রহ্ম বা আত্মার এই তিন পাদ; মাত্রাহীন ব্রহ্ম তুরীয়। ব্রহ্ম বা আত্মার এই তিন পাদ হইলেন প্রণবের ত্রিমাত্রা। জাগ্রৎ-স্থান বৈশ্বানর হইলেন প্রণবের প্রথম ‘অ’কার মাত্রা; স্বপ্নস্থান তৈজসই প্রণবের দ্বিতীয় মাত্রা ‘উ’কার এবং সুষুপ্তিস্থান প্রাজ্ঞই প্রণবের তৃতীয় মাত্রা ‘ম’কার। এ তিনের উপাসনায় স্তরানুক্রমিক ফললাভ। কিন্তু, মাত্রাহীন প্রণব তুরীয়, ব্যবহারাতীত, প্রপঞ্চের নিবৃত্তিস্থল, শিবময়, অদ্বৈত ও পরমাত্মস্বরূপ। এ তত্ত্ব যিনি অবগত, তিনি স্বয়ং পরমাত্মাতেই প্রবেশ করেন—“সংবিশত্যাত্মনাত্মানং।”
প্রণবের চারি মাত্রায় যজ্ঞ, বেদ, দেবতা, ছন্দঃ ও উচ্চাবচ লোকসমূহের অধিষ্ঠান কিরূপে বিদ্যমান, নৃসিংহতাপনী উপনিষদে উহার বিস্তৃততর বর্ণনা লভ্য। প্রণবের প্রথম মাত্রা ‘অ’কার—পৃথিবী, ঋগ্বেদ, ব্রহ্মা, বসুগণ, গায়ত্রী ছন্দঃ ও গার্হপত্য অগ্ন্যাত্মক; দ্বিতীয় মাত্রা ‘উ’কার—অন্তরীক্ষ, যজুর্ব্বেদ, বিষ্ণু, রুদ্রগণ, ত্রিষ্টুপছন্দঃ ও দক্ষিণাগ্ন্যাত্মক; তৃতীয় মাত্রা ‘ম’কারে আছে স্বর্গ, সামবেদ, রুদ্র, আদিত্যগণ, জগতীছন্দঃ ও আহবনীয় অগ্নি এবং চতুর্থ মাত্রায় সোমলোক, ওঁকার, অথর্ব্ববেদ, সব্বর্ত্তক অগ্নি, মরুদ্গণ ও বিরাট ছন্দঃ বিদ্যমান। সমগ্র বিশ্বই যে প্রণবে অবস্থিত অথবা প্রণব যে সর্ব্বব্যাপী, সর্ব্বাত্মক, তাহাই এই উপনিষদের প্রতিপাদ্য। প্রণবব্রহ্ম এক ও অদ্বিতীয়; আর এই সকলই তাঁহার লীলাবিগ্রহ।
প্রণবনাদ
প্রণব ঈশ্বরের বাচক। বাচক অর্থে অভিধায়ক শব্দ। অর্থাৎ, প্রণব এমন একটি শব্দ যাহার মাধ্যমে ঈশ্বর সম্বন্ধীয় পূর্ণ জ্ঞান লাভ হয়। প্রণবের ভিতরেই ঈশ্বরের সকল শক্তি, সকল মহিমা, সামগ্রিক স্বরূপ বিদ্যমান। ব্রহ্মের কোনও নাম নাই; কিন্তু নামকরণ যদি করিতেই হয় তবে এমন নাম নির্বাচন করিতে হইবে, যাহার ভিতরে সকল শব্দের একীভূত সমাবেশ রহিয়াছে, তবেই সেই নাম হইবে সার্থক ও পূর্ণাঙ্গ। “ও” বা ‘প্রণব’—সকল শব্দের জনক। লক্ষ মানুষের মেলায় লক্ষ কথা হইতেছে, দূর হইতে কর্ণপাত কর, শুনিবে শুধু “ওম্”। এই “ও” হইলেন নাদব্রহ্ম; এই “ও”ই ব্রহ্মের স্বাভাবিক নাম। নাম ও নামী অভিন্ন। ব্রহ্ম ও প্রণবেও অভিন্ন সম্বন্ধ।
ঈশ্বরের প্রণব নামটি মানুষের দেওয়া নয়—ইহা অপ্রাকৃত। আপন পরম কারণনাদেই পরমেশ্বর আপন নাম ঘোষণা করিতেছেন। ঐ অনন্ত পুরাতন ব্যোমব্যাপিয়া অনাদিকাল হইতে অনুরণিত হইতেছে ঐ পর নাদ “ও”। ভোগীদের শুনিবার কাণ নাই, তাই শুনিতে পায় না; কিন্তু, যোগীরা তাহা শুনিতে পান। ঐ নাদময় ব্রহ্মের বিচিত্র মূর্চ্ছনা তাঁহারা আপন শরীরাভ্যন্তরেও শুনিয়া থাকেন।
স্বামী নির্ম্মলানন্দের ‘শ্রীশ্রীপ্রণবানন্দ—শত রূপে, শত মুখে’ থেকে