যাঁরা ভগবৎ কৃপা লাভ করেছেন, তাঁরাও এ পৃথিবীর মানুষ। আর এই পৃথিবীই হলো একমাত্র সাধনক্ষেত্র। দেব জগতের দেবতাগণ ভগবানকে জানেন না। ভগবানকে জানতে হলে বা তাঁকে উপলব্ধি করতে হলে দেবতাদেরও এই মাটির পৃথিবীতে এসে বসবাস করতে হবে এবং সাধনা করতে হবে। কিন্তু তাঁরা এই মাটির পৃথিবীকে ভীষণ ভয়ের চোখে দেখেন। দেবতাগণ যে এই পৃথিবীকে ভয় পান, তার কতকগুলি কারণও আছে। প্রথমতঃ দেবতা থাকাকালে এঁরা ছিলেন মানুষের কাছে সম্মানীয়, কিন্তু পৃথিবীতে আসার পর সে সম্মান তাঁরা পাবেন না। দ্বিতীয়তঃ দেবভোগ বন্ধ হয়ে যাবে এবং চরম কষ্টের মধ্যে এই পৃথিবীতে থাকতে হবে। তৃতীয়তঃ এই স্থূলশরীর বড় কষ্টদায়ক এবং বন্ধনের কারণ। যদি বিচার করে চলা না যায় তবে আরও নিম্নগতি হতে হবে। এসব কারণ তো আছেই, তাছাড়া নিজেদের ইচ্ছাও তাদের নামাবার প্রবৃত্তিকে বাধা দেয়। কিন্তু এ পৃথিবীতে না নামলে তাঁরা ভগবানকে জানতে পারবেন না। এজন্যই মহাপুরুষগণ এই পৃথিবীর উদ্দেশ্যে বলেন—ধন্য তুমি বসুন্ধরা। তোমার এই মাটির বক্ষে কত সম্পদ তুমি করে রেখেছো মা! কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো—তোমাকে সকলে ভোগের সামগ্রী ভেবে লক্ষ লক্ষ জনম এই ভোগের জন্যই ঘুরছে। ফলে মায়ায় বশীভূত হয়ে মোহাচ্ছন্ন অবস্থায় আরও নিম্নগামী হচ্ছে। তাই আজ মানুষের মধ্যে পশুত্বভাব ক্রমশ প্রবলতর হচ্ছে এবং চরম অশান্তির মধ্যে কালাতিপাত করছে। তাদের দুঃখের আর সীমা নেই। অথচ এই মানুষ একদিন দেবতা ছিল, ঈশ্বর ছিল—লোভে বশীভূত হয়েই এই ধরণীতে এসেছিল। তাই তাদের এতো দুর্ভোগ। নিজ ঘরে ফেরবার আশা নেই। আবার অনেকে এসেছিল ভগবানকে জানবার উদ্দেশ্যে। আজ তারা সে কথা ভুলে গেছে। কই, তাদের তো ব্রহ্ম আত্মা-ভগবানকে জানবার প্রবৃত্তি এলো না? এ সব ঘটনা দেবতাগণ উপলব্ধি করছেন।
আজ এই পৃথিবীর মানুষ দেবজগতে ফেরবার জন্য দেবতার পূজা-আরাধনায় মেতে উঠেছে। কিন্তু এদের দেব জগতেও স্থান নেই। অবশ্য কিছু ভাল কর্ম করে দেবভোগ পেতে পারে এবং তা ভোগ করে আবার এই মাটির ধরণীতে ফিরে আসছে। এও তাঁর একপ্রকার লীলা। মানুষ ভোগ চায় বলেই সে তা পায়। ভক্ত ভগবানের কাছে যা প্রার্থনা করে তা থেকে বঞ্চিত হয় না। অবশ্য এ চাওয়ার মধ্যে একাগ্রতা ও আকুলতা চাই। তাই ভক্ত যে বস্তু নিয়ে ধ্যান ধারণা করে ভগবানের কাছ থেকে সে তাই পায়। এ সবই ভগবৎ লীলা। সমগ্র জগতে মহামায়ারই লীলা। এ সব কিছু ভগবানই সৃষ্টি করেছেন। হয়তো কেউ কেউ বলবেন যে, ভগবান জেনেশুনে এ সব মোহ সৃষ্টি করলেন কেন? তারও কারণ আছে। কারণ হলো কোন সুন্দর বস্তুকে অসুন্দরই রক্ষা করে। অসুন্দর না থাকলে সুন্দর সৃষ্টি হতো না। তাই মায়া না থাকলে বিদ্যা উপলব্ধি করা যেতো না। যেমন—মন্দ না থাকলে ভাল মর্যাদা পেতো না। তাই তিনি যেমন সুন্দর বস্তু সৃষ্টি করেছেন, তাকে রক্ষা করার জন্য তেমনই মন্দ বস্তুও সৃষ্টি করেছেন। যেমন—একটি নারকেল। এর সুমিষ্ট শাঁসটি রক্ষা করার জন্য একটি শক্ত মালার সৃষ্টি করলেন। আবার ওই মালাকে রক্ষা করার জন্য সৃষ্টি করলেন ছোবড়া।
শ্রীশ্রী আচার্য জ্ঞানেশ্বরদেব প্রণীত ‘জ্ঞানেশ্বরোপনিষদ্’ (৪র্থ খণ্ড) থেকে