বেদান্তের তিনটি চিন্তাপদ্ধতি আছে। প্রথমতঃ আমরা তিনটি পদ্ধতিই উল্লেখ করব। তারপর তাদের মধ্যে সামঞ্জস্য আমরা দেখাব। প্রথমেই দ্বৈত পদ্ধতির আলোচনা করা যাক। যতদিন আমরা নিজেদের শরীর ব’লে চিন্তা করি, যতদিন আমরা বর্হিজগৎ বা ইদ্রিয়গ্রাহ্য জগৎ সম্বন্ধে সচেতন আছি, ততদিন পর্যন্ত আমরা মনে করি যে একজন সৃষ্টিকর্তা বা শাসনকর্তা আছেন, এবং সেই শাসনকর্তাই হলেন ঈশ্বর। প্রথমে আমরা তাঁকে বিশ্বাতীত ব’লে মনে করি, যিনি আকাশে দূরে মেঘেরও ঊর্ধ্বে কোন স্থানে বসে আছেন, যার কাছে আমরা পৌঁছাতে পারি না। তিনি আমাদের মনেরও নাগালের বাইরে। ইহুদী ধর্মমতে আমরা এই স্তরের কথা পাই। দ্বৈতবাদীরা বিশ্বাস করে যে ঈশ্বরকে জানা যায় না, তাঁকে উপলব্ধি করা যায় না, আমাদের থেকে তিনি বহুদূরে অবস্থান করছেন; তিনি এত মহিমময় বা গৌরবোজ্জ্বল যে তাঁর কাছে যাওয়া সম্ভবপর নয়। ইসলামধর্মেও এই ভাব বিকশিত হয়েছে। একে আমরা অবশ্যই প্রথম পদক্ষেপ হিসাবে মনে করব তাঁকে উপলব্ধি করার জন্য, যিনি হলেন সেই অসীম সত্তা—সেই সীমাহীন জ্ঞানসমুদ্র, যা হ’ল ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বিশ্বজগতের ভিত্তিমূল। এই স্তরে ঈশ্বরকে বোধ হয় যে তিনি বিশ্বাতীত, তিনি প্রকৃতি-জগতের বহির্দেশে বিরাজমান। তারপর ক্রমে ঈশ্বরত্বের যথার্থ-স্বরূপ কি ও ঈশ্বরত্বের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক কি, তা যতই আমরা উপলব্ধি করতে থাকি ততই আমরা কি দেখতে পাই? আমরা দেখতে পাই যে তিনি আমাদের নিকট হ’তে বহু দূরে বিরাজমান নন; তিনি এখানে, সেখানে, সর্বত্র রয়েছেন; তিনি আমাদের ভিতরেই আছেন; তিনি বিশ্বব্যাপী। বাস্তবিকপক্ষে তিনি প্রকৃতির ভিতর অনুপ্রবিষ্ট ও বিরাজমান। তিনি বিশ্বলীন। তিনি বাইরে থেকে শাসন করেন না, ভিতরে থেকেই শাসন করেন। আত্মা যেমন দেহের শাসনকর্তা ও সঙ্গে সঙ্গে দেহকে শাসন করে, তেমনি বিশ্বের প্রভু এই প্রাকৃতিক জগতে প্রবেশ করেছেন ও এর প্রতিটি অণু-পরমাণুকে নিয়ন্ত্রিত করছেন আর তিনি ভিতর থেকেই নিয়ন্ত্রণ করছেন, বাইরে থেকে নয়। সমস্ত ব্যষ্টি-আত্মাই হ’ল সৃষ্টিকর্তা ঈশ্বরের অংশ—চেতন, অচেতন ও ঈশ্বর। একদিকে চেতন ও অচেতনের সম্পর্ক, অপরদিকে ঈশ্বর—এটাই হ’ল আত্মার সঙ্গে দেহের সম্পর্ক।
দ্বৈত ও অদ্বৈত নামে দুটি মতবাদ আছে। অদ্বৈত-দর্শনের প্রখ্যাত ব্যাখ্যাকর্তা শঙ্করাচার্য বলেন যে, ঈশ্বরে মানুষভাব আরোপ করার প্রবণতা হ’তে ঊর্ধ্বে উঠতে হবে সব মানুষকেই, এবং তখন তারা বুঝতে পারবে যে তারা হ’ল সত্যিকারের আত্মা, তাদের অন্তরজীবনের এবং জীবাত্মা ও দৃশ্যমান জগতের সারসত্তা; আর তখনই তারা উপলব্ধি করবে পরিপূর্ণ ঐক্য ও সামঞ্জস্য, সর্ববিধ অনৈক্য ও অসামঞ্জস্যের মধ্যে। কেবল তখনই পরমাত্মার সঙ্গে তাদের সত্তার পূর্ণ ঐক্যের উপলব্ধিতে তারা পৌঁছাবে এবং বহির্জগতের সব বস্তুই ধুয়ে-মুছে যাবে—বাইরের সবকিছুই হবে দিব্যভাবে পরিপৃক্ত।
স্বামী অভেদানন্দের ‘প্রাত্যহিক জীবনে বেদান্তের প্রয়োগ’ থেকে