মহাজলধির জলে যেমন লুক্কায়িত থাকে আকুল উচ্ছাস, কমল কলিকায় যেমন গুপ্ত থাকে পবিত্র পরিমল, এ গায়ত্রী ঋষিদের শ্রবণের পথে প্রবেশ করে তাদের হৃদয়ের নিদ্রিত উচ্ছাস জাগায়ে তুলতঃ তাঁর তখন ক্ষুদ্র অং সৃষ্টি ভেদবুদ্ধির অতীতে সর্বব্যাপী বিশ্বসত্তার সাথে একাত্মকার অনুভব করতেন। পুরী মহারাজ অতি সংক্ষেপে তাঁর গ্রন্থাবলীতে এ প্রণবের উল্লেখ করেছেন। প্রণবের অর্থ কী? পুরী মহারাজ বলেন, এর দ্বারা প্রকৃষ্টরূপে ভগবানের স্তব করা যায়, অতএব একে প্রণব বলা হয়। ওঁ কারের শাস্ত্রসম্মত যথার্থ নামই প্রণব। এই গায়ত্রীকে সাধারণঃ দুই ভাগে বিভক্ত করা হয়-ব্যাহৃতি ও সাবীত্রী। “ওঁ ভূর্ভূবঃ স্বঃ গায়ত্রীর এ অংশের নাম ব্যাহৃতি। ব্যাহৃতি শব্দের অর্থ (বি+আহৃতি) ‘সংসার যবে মন কেড়ে লয় জাগে না যখন প্রাণ’, অর্থাৎ আমাদের চঞ্চল চিত্ত যখন বৈষয়িক জটিলতায় জড়িয়ে পড়ে এবং মন নিঃস্বার্থ ভাবে উচ্চতর ভূমিতে আরোহণ করবার শক্তি হারায়ে সেই অবস্থা হতে মনকে আহরণ (আহৃতি) করে ফিরিয়ে আনতে হবে। এ আহরণ শুধু কথার কথা নহে, নিজের মধ্যে সেই আহরণ দেবজন্ম সার্থক করে তোলে। তাই এ আহরণের অর্থ নিখিল বিশ্বজগৎ নিজের মধ্যেই অনুভব করতে হবে; এর যেন আর বাইরে নেই, ইহা যেন সাধকের অন্তরের মধ্যে বিশেষ ভাবে আহৃত হয়েছে। এ অনুভূতি জাগলে সাধক তখন নিজেকে কোন বিশেষ স্থানে, বিশেষ গৃহে, বিশেষ পরিবেশে সীমাবদ্ধ বলে মনে করেন না; তিনি তখন নিজেকে সর্ববিশ্বের অধিবাসী বলে ভাবতে থাকেন এবং তখন অনন্ত ব্রহ্মাণ্ডের সাথে তাঁর যেন ঐক্যবোধ সংস্থাপিত হয়। এ ঐক্যবোধের ফলে মন তখন ক্ষুদ্র পৃথিবীর সীমা ছাড়িয়ে উধাও হয়ে যায়, তখন “স্বদেশ ভুবনত্রয়ম্” আচার্য শঙ্করের এই মহান বাক্যই সার্থকতা প্রাপ্ত হয়।
গায়ত্রী মন্ত্রকে সার্থক করতে হলে সাধককে প্রথমতঃ দ্বৈতবোধ হতে মুক্ত হয়ে ব্যাহৃত সাধনায় সিদ্ধ হতে হবে, সেই সিদ্ধির ফলে সাধক অন্তরে অনুভব করবেন-আমি ছোট নহি, আমি হীন নহি, আমি বৃহৎ অনন্ত বিশ্বের সহিত ঐক্যযুক্ত; এ বিশ্বের প্রাণ আমারই প্রাণ, বিশ্বের সুখ দুঃখ আমারই সুখ দুঃখ,-এ জগৎ হতে বিচ্ছিন্ন আমার পৃথক অস্তিত্ব নাই। ব্যাহৃতির সাধনাই এ ঐক্যবোধে আরোহণে সহায়তা করে। প্রভাতে উঠে আর্য ঋষি সর্বাগ্রে গায়ত্রীর অন্তর্গত এ ব্যাহৃতির ধ্যানযোগে নিখিল আত্মার সঙ্গে আপন আত্মাকে একীভূত করে নিতেন; তখন চন্দ্র রবি তারা, অনন্ত জ্যোতিষ্কমন্ডলী, বিশাল সৌরজগৎ এবং তদন্তর্গত প্রতিটি বস্তুকে যোগী পরম আত্মীয়রূপে নিজের আহরণ করতঃ বিশ্বজনীন ভাবে আপ্লুত থাকতেন। এভাবে বিশ্বলোক নিজের মধ্যে আহৃত হলে তখনই গায়ত্রীর সাবিত্রী অংশ অন্তরে মন্দ্রিত হতে থাকে।
এ আলোকে বা শক্তি স্বয়ং বিশ্বেশ্বরেরই শক্তি; বিশ্বের মধ্যেই সেই শক্তি প্রত্যক্ষীকৃত। আমরা সাধারণ মানব সেই শক্তির, সেই আলোকের উদার অনন্ত আশীর্বাদ ক্ষণে ক্ষণে অবারিত অজস্রতায় লাভ করেও, ভোগ করেও, বুঝতে পারে না যে, সেই আলোকের মধ্যে নিহিত আছেন আলোকপতি, বিশ্বপতি; তিনি ও তাঁর আলোক এবং তাঁর বিশ্ব অভিন্ন, তিনি ও তাঁর সৃষ্টি অভিন্ন; কাজই তাঁর আলোকে ধ্যানের মাধ্যমে আমরা তাঁকেই ধ্যান করি।
দীপঙ্কর চৌধুরীর ‘অমৃত পুরুষ অদ্বৈতানন্দ’ থেকে