আত্মানন্দ শুধুমাত্র ধ্যান-তপস্যাতেই ডুবিয়া থাকিতে পারেন নাই। প্রকৃতপক্ষে ‘আত্মনো মোক্ষার্থৎ জগদ্ধিতার চ’ ইহাই ছিল তাঁহার শ্রীগুরুর প্রত্যাদিষ্ট জীবনাদর্শ। তাই ‘শিবজ্ঞানে জীবসেবা’র আবেদনও তাঁহার হৃদয়ে জ্ঞানচর্চা বা ভক্তিসাধনারই অনুরূপ সাড়া জাগাইত। ১৮৯৯ খ্রীষ্টাব্দের ৩১শে মার্চ, স্বামিজীর আদেশে রামকৃষ্ণ মিশন যখন প্লেগ-কবলিত কলিকাতাবাসীর সেবায় অগ্রসর হইয়াছিলেন, তখন সেই ঐতিহাসিক সেবাকার্যে আত্মানন্দের সেবা-নিষ্ঠার অদ্ভুত পরিচয় পাওয়া গিয়াছিল। ঐ সেবান্দোলনের নেতা ছিলেন স্বামিজীর প্রিয় শিষ্য সদানন্দ স্বামী—আত্মানন্দ ও ভগিনী নিবেদিতা ছিলেন তাঁহারই প্রধান সহকারিদ্বয়। ১৯০০ খ্রীষ্টাব্দের শেষাশেষি বা ১৯০১-এর প্রথম দিকে তিনি কিষেণগড়ে দুর্ভিক্ষ-পীড়িত জনসাধারণের সেবায় গুরুভ্রাতা কল্যাণানন্দকে সাহায্যার্থ মঠ হইতে প্রেরিত হইয়াছিলেন। সেখানেও তাঁহার উদ্যম বিস্ময়কর ছিল। আত্মানন্দের এই সেবাভাব যথার্থই প্রত্যক্ষ-অনুভবজাত,—নিছক কর্তব্যবুদ্ধি-প্রণোদিত ছিল না। পরবর্তী জীবনেও দেখা যাইত, কত নিষ্ঠা ও প্রাণ সংযুক্ত থাকিত তাঁহার সেবাদৃষ্টিতে। যখন তিনি ঢাকা মঠের অধ্যক্ষ, তখন একদিন আশ্রম পরিচালিত চিকিৎসালয়ের রোগীদের পথ্য গ্রহণের পূর্বে সাধু সেবকগণ আহার করিতে বসিলে, তিনি ব্যথিতচিত্তে সকলকে তিরস্কার করিয়া বলিয়াছিলেন, “নারায়ণদের আগে না খাইয়ে, তোমরা কি করে খেতে বসলে?” আহা সেদিন কতই না বিরক্তি ও বেদনা তাঁহার মুখেচোখে ফুটিয়া উঠিয়াছিল! মানুষের মধ্যে এই নারায়ণ-দৃষ্টি আত্মানন্দের জীবনে অতি স্বাভাবিক হইয়াছিল, স্বামিজীরই কৃপায়।
আত্মানন্দের গুরুভক্তি ও গুরুবাক্যে বিশ্বাস ছিল অনন্যসাধারণ। বরাবরই তিনি নিরামিষাশী—মনে হয়, এ সংস্কার তাঁহার বেশ প্রবলই ছিল। স্বামিজী একদিন শিষ্যের এই সংস্কার কত দৃঢ়, অথবা তাঁহার গুরুর প্রতি শ্রদ্ধা কতখানি অকপট তাহা পরীক্ষার জন্য সহসা নিজের হাতে মাছের টুকরা আত্মানন্দের পাতে তুলিয়া দিয়াছিলেন। গুরুদেবের প্রসাদজ্ঞানে শিষ্য নিঃসঙ্কোচে ও পরম শ্রদ্ধার সহিত সেই মাছ গ্রহণ করিতে উদ্যত হইলে স্বামিজী সংস্কারমুক্ত শিষ্যের ভক্তিতে প্রীত হন, এবং তাঁহার নিষ্ঠার খুব প্রশংসা করিয়া উহা ভঙ্গ করিতে নিষেধ করেন। স্বামী আত্মানন্দের জীবনের সর্ববিধ সিদ্ধির মূলে ছিল, তাঁহার অগাধ বিশ্বাস—অবিচল গুরুভক্তি। একদা স্বামিজী তাঁহার নিজের সম্পর্কে নানা উদ্ভট ও কৌতুকপূর্ণ কতকগুলি মন্তব্য করিয়া সরল শিষ্যকে পরখ করিবার জন্য বলেন, “...ভেবে দেখ্, তবুও কি আমাকে তুই গুরু বলে মানবি?” আত্মানন্দ মুহূর্ত বিলম্ব না করিয়া উত্তর দিয়াছিলেন, “আপনি যা খুশি বলুন, যা ইচ্ছা করুন। আমি জানি আপনিই আমার ইহকাল-পরকাল।” পরিণত বয়সে তাঁহাকে প্রায়ই বলিতে শোনা যাইত, “গুরুবাক্যে ও বেদান্তবাক্যে বিশ্বাস সাধুজীবনের শ্রেষ্ঠ সম্বল।”
স্বামী অব্জজানন্দের ‘স্বামীজীর পদপ্রান্তে’ থেকে