বেদান্তের আদর্শ হ’ল জীবনসমস্যার সমাধান করা, মানবজীবনে উদ্দেশ্য নির্দেশ করা, মানুষের জীবনযাপনকে উন্নত করা, আর যে বিশ্ব-ইচ্ছাশক্তি প্রকৃতির মধ্যে ক্রিয়াশীল রয়েছে, তার সাথে মানবজীবনকে অধিকতর সামঞ্জস্যপূর্ণ করা। বেদান্ত আমাদের উপলব্ধি করায় যে, যে ইচ্ছাশক্তি বর্তমানে আমাদের দেহের মধ্যে সক্রিয় আছে, তা বাস্তবিকপক্ষে বিশ্ব-ইচ্ছাশক্তিরই অংশ মাত্র। বেদান্ত আরও শিক্ষা দেয় যে, দেহ বা ইন্দ্রিয়সুখভোগ মনুষ্যজীবনের যথার্থ কল্যাণসাধন করে না। বেদান্ত আমাদের সজাগ করে যে, বর্তমানে আমরা হাত-পা-বাঁধা দাসের মতো জীবনযাপন করছি এবং এই দাসত্ব হ’তে মুক্তি পাওয়ার পথের অনুসন্ধান আমাদের অবশ্যই করতে হবে। বেদান্তের আদর্শ হ’ল আমাদের দৃষ্টি খুলে দেওয়া সত্য ও বাস্তবতার দিকে, যা চিরন্তন ও অপরিবর্তনীয়। বেদান্ত আমাদের বুঝিয়ে দেয়, দুঃখ-যন্ত্রণায় বিহ্বল না হয়ে যেকোন ধরণের দুর্ভোগ ও দুর্ভাগ্য, যা প্রত্যেক মানুষের জীবনে কোন-না-কোনভাবে আসবেই, তাতে বিচলিত না হয়ে কিভাবে আমরা এ জগতে বসবাস করতে পারি। বেদান্তের আদর্শ আমাদিগকে শিক্ষা দেয় কি ক’রে এই জীবনে মৃত্যুকে জয় করা যায়—কি ক’রে বিন্দুমাত্রও ভীত না হয়ে আমরা মৃত্যুকে বরণ করতে পারি। আর সর্বোপরি বেদান্তের মূল উদ্দেশ্য হ’ল মানুষকে নিঃস্বার্থ ও পবিত্র জীবনযাপন করতে এবং এ জীবনেই পূর্ণতা লাভ করতে প্রস্তুত করা। যদিও ক্রমবিকাশের স্বাভাবিক প্রক্রিয়াতে প্রতিটি মানুষ ক্রমবিকাশের স্তরগুলি অতিক্রম ক’রে এবং প্রতি স্তরেই অভিজ্ঞতা অর্জন ক’রে পূর্ণতা লাভ করে, কিন্তু তা একটি কঠিন ও বিরক্তিকর পদ্ধতি, তাই এ প্রক্রিয়া যাদের জানা আছে, তা তাদের কাছে মোটেই কাম্য নয়। সুতরাং বেদান্ত আমাদের বলে, কি ক’রে আমরা এই শৃঙ্খল হ’তে রেহাই পেতে পারি, কি ক’রে পূর্ণতা লাভের সময়কে সংক্ষেপ করতে পারি এবং কর্মফললাভের জন্য পুনঃ পুনঃ জন্মগ্রহণ না ক’রে, এই জীবনেই কি ক’রে পূর্ণতা অর্জন করতে পারি।
বেদান্তের আদর্শ হ’ল মানুষকে অবহিত করা—কি শক্তি তার মধ্যে নিহিত রয়েছে ও তার প্রকৃত স্বরূপ কত মহান ও মহিমাময়। বেদান্তের উদ্দেশ্য হ’ল সত্যিকারের বিশ্বভ্রাতৃত্ব প্রতিষ্ঠিত করা। আমি সেই ধরণের বিশ্বভ্রাতৃত্বের কথা বলছি না যার কথা আমরা প্রায়ই শুনতে পাই এবং যা সঠিকভাবে বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে সেটা শুধু বাইরের একটা আবরণ, যার ভিতরে লুকিয়ে আছে হিংসা, ঈর্ষা, কলহ, শত্রুতা ও নামযশ এবং তুচ্ছ জাগতিক সমৃদ্ধির জন্য লড়াই ইত্যাদি; কিন্তু এই তথাকথিত বিশ্বভ্রাতৃত্বের চেয়ে মহত্তর কিছুর কথা আমি বলতে চাইছি। তা হ’ল বিনিময়ে কিছু না চেয়ে সবার প্রতি সত্যিকারের ভালবাসা, আমি সেই ধরণের বিশ্বভ্রাতৃত্বের কথা বলছি, যার মূল হ’ল আন্তরিক ও নিঃস্বার্থ ভালবাসা। ভালবাসা হ’ল একত্বের বহিঃপ্রকাশ অথবা বলা যায়, এ হ’ল সেই অনুভূতি যা আত্মার একত্বের উপলব্ধি থেকে আসে। বেদান্তের উদ্দেশ্য হ’ল সেই একত্ব প্রতিষ্ঠিত করা এবং সামঞ্জস্য, শান্তি, সহনশীলতা আনয়ন করা—জগতে যত বিভিন্ন ধর্ম-সম্প্রদায়, ধর্মীয় মত, ধর্মীয় শ্রেণী আছে তাদের সবার মধ্যে। এর লক্ষ্য হ’ল আমাদের শিক্ষা দেওয়া কি ক’রে আমরা আত্মার একত্বের দিক হ’তে সমস্ত নরনারীর সমান অধিকার স্বীকার করতে পারি; আর এইভাবে বিভিন্ন দেশের ও বিভিন্ন জাতির সর্ববিধ সামাজিক, রাজনৈতিক ও ধর্মীয় আন্দোলনকে একটা দৃঢ় ভিত্তির ওপর স্থাপিত করতে পারি।
স্বামী অভেদানন্দের ‘প্রাত্যহিক জীবনে বেদান্তের প্রয়োগ’ থেকে