‘‘যে যথা মাং প্রপদ্যন্তে তাংস্তথৈব ভজাম্যহম্‌।
মম বর্ত্মানুবর্ত্তন্তে মনুষ্যাঃ পার্থ সর্বশঃ।।’’
কৃষ্ণ বলছেন, পরমপুরুষকে যে মানুষ যেভাবে চায় অর্থাৎ পরম পুরুষের কাছ থেকে যে মানুষের যে ধরনের আকাঙ্ক্ষা সে সেই রকমের জিনিসই পায়। কারুর ইচ্ছে—খুব খাবো, পরমপুরুষ তার ইচ্ছে পূর্ণ করবেন। সে হয়তো পরের জন্মে নেকড়ে বাঘ কিংবা শুয়োর হয়ে জন্মাবে। কেবল খাচ্ছে—কেবলই খাচ্ছে। কারুর হয়তো ইচ্ছে—খুব গয়না পরব, পরের জন্মে সে হয়তো ময়ূর হয়ে জন্মাবে। শরীরে নানান ধরনের ছাপ—তারপর কেউ হয়তো দুই দিন পরে তির ছুড়ে তাকে মেরে ফেলবে। যেমনটি চাওয়া তেমনটি পাওয়া—পরমপুরুষকে যে যেভাবে চায় সে সেইভাবে পায়। সুতরাং এই চাইবার আগে বেশ একটু সতর্ক হয়ে চাইতে হবে। কেউ হয়তো রাজা হতে চাইল। ঠিক আছে, পরের জন্মে সে হয়তো গরীবের ঘরে জন্মাল কিন্তু নামটা হ’ল ‘রাজা’। রাজা হতে চেয়েছিল রাজা হয়েছে। তাই চাইতে হয় সতর্কভাবে। এ বিষয়ে বেশ মজার গল্প আছে। কোন একজন একবার শিবের কাছে বর চেয়েছিল—অমর হব। শিব বললেন, ‘‘দেখ,অমর হওয়া তো যায় না। তাই বুঝে-সুজে বর চাও।’’ সে বলল—‘‘ঠিক আছে, আমি দিনেও মরব না, রাতেও মরব না,’’ তাই সে মরল সন্ধেবেলায়। সবচেয়ে ভাল হচ্ছে—কিছু না চাওয়া।
কৃষ্ণ বলছেন, ‘‘যে যেমনভাবে চাইবে আমি ঠিক তেমনিভাবেই তার মনোমত ইচ্ছা পূরণ করব।’’ মানুষ তার ভক্তির স্তর অনুযায়ী তার চাওয়াটা নির্ধারণ করে, কারণ ভক্তি যদি খুব বেশী স্বার্থপ্রণোদিত হয়, তাহলে সে কী চাইবে?—না, অমুক লোকটা আমাকে বড্ড জ্বালাতন করছে, অমুক ভাড়াটেটা কিছুতেই উঠতে চাইছে না, অমুক আমার শত্রু—অতএব, হে ভগবান, হে নারায়ণ, ওকে শেষ করে দাও, নিপাত করে দাও। এখন কেউ যদি বলে—হে ভগবান, লোকটা আমার শত্রু, তুমি ওকে শেষ করে দাও, নারায়ণকেও তো বুঝে-সুঝে কাজ করতে হবে, কারণ শত্রুও তো বলবে—হে নারায়ণ, আমার শত্রুটাকে শেষ করে দাও। তাই নারায়ণের পক্ষে মুশকিল হ’ল—কোন্‌ কুল তিনি রাখবেন, কার মনোরঞ্জন করবেন তিনি। তাঁকে সামলে চলতে হচ্ছে সকল দিক। সুতরাং কেউ যদি পরমপুরুষকে বলে আমার শত্রু নিপাত করে দাও, আমার পথের কাঁটাটি সরিয়ে দাও, তাহলে পরমপুরুষ যা ভাল বুঝবেন তা-ই করবেন। তবে একথা ঠিক, এই শ্রেণীর ভক্তরা কখনও পরম পুরুষকে কোন দিন কাছে পাবে না কারণ সে তো পরমপুরুষকে চায়নি। যখন চায়নি তখন নিশ্চয়ই তা’ সে পাবে না। মা রান্না করছেন, শিশু চীৎকার করছে। ছোট্ট ছেলে—মা তাকে একটা খেলনা দিয়ে, লাল রঙের কোন একটা জিনিস দিয়ে ভুলিয়ে বসিয়ে রেখে আবার কাজ করতে চলে গেলেন। কিন্তু শিশু যদি জেদী হয়, খেলনা না নিয়ে সে যদি কেবল মাকেই চায়, তখন মায়ের মহা মুশকিল। কিছুক্ষণের জন্যে রান্না বন্ধ রেখেও ছেলেকে নিয়ে ভোলাতে হবে। আদর করতে হবে। এছাড়া অন্য কোন পথ নেই। নইলে চীৎকার করে সে পাড়া মাৎ করবে। পাড়ার লোকেরা বলবে, ‘কী রকমের মা রে বাবা! ছেলের দিকে তাকায় না!’’
যারা চায়—শত্রু নিপাত করে দাও, নারায়ণ তার শত্রু নিপাত করুন আর নাই করুন, সে পরমপুরুষকে পাবে না। এতে কোন সংশয় নেই। সুতরাং চাওয়াটা খুব সতর্কতার সঙ্গে নির্ধারণ করতে হবে।
আবার কেউ কেউ বলে—না, না, শত্রুর নিপাত চাই না, আমার খুব উন্নতি হোক, আর্থিক উন্নতি হোক, চাকরি-বাকরির উন্নতি হোক। চাকরি-বাকরির উন্নতি চাইছে, এমন লোকও তো অনেক রয়েছে—সেক্ষেত্রে কাকে রেখে কাকে নেবেন! ওপরের পোস্ট বা পদ একটাই—সেটা কাকে দেবেন, কাকে দেবেন না! তিনি সেক্ষেত্রে যোগ্যতা অনুযায়ী হয়তো ব্যবস্থা করে দেবেন। তা যা চাওয়া হচ্ছিল তা, সে পেতেও পারে, নাও পেতে পারে। তবে একথা ঠিক, সে পরমপুরুষকে পাবে না কারণ সে তো পরমপুরুষকে চায়নি।
প্রথমোক্তটায় যারা শত্রুর নিপাত চায়, তাদের বলা হয় তামসিক ভক্ত। আর যারা চায়—আমার এই উন্নতি হোক, তারা তামসিক ভক্ত নয়, কারণ তার অপরের ক্ষতি হচ্ছে না কিন্তু তারা যে জিনিসটা চাইছে, সেটা যুক্তিসঙ্গত হতেও পারে, আবার নাও হতেও পারে।
শ্রীশ্রীআনন্দমূর্ত্তির ‘আনন্দ বচনামৃতম্‌’ থেকে