একদিন কথা প্রসঙ্গে শান্তিদেবী হরিচাঁদকে বলেন, প্রভু, সংসারের কাজ তুমি কিছুই করনা, সর্বদা ভক্তগণ নিয়ে কাল কাটাও। আমি একা পুত্র কন্যাগণ নিয়ে তোমার দয়া বিনা কিভাবে সংসার যাত্রা নির্বাহ করবো, বলো’ত? মধুর হেসে হরিচাঁদ বলেন, আমি কি কাজ করবো বল, জমি জমা, কৃষিকাজ কিছুই জানি না। জন্মে জন্মে শুধুমাত্র গোধন চরাইতেই জানি। তাছাড়া তুমি’ত জান আমি সর্ব কর্ম ত্যাগ করে শুধুমাত্র ঈশ্বরের উপর আত্মসমর্পণ করে বসে আছি। আমি মনস্থ করেছি যিনি এই জগৎ সংসারের সকলের জন্য চিন্তা করেন সেই চিন্তামণির শরণ নিয়ে ভক্ত সঙ্গে হরিকথায় কাল কাটাবো, দেখি তিনি আমার আহার যোগান কিনা যোগান। এই কথা বলে তিনি গৃহ ছেড়ে ভক্তগণ নিয়ে হরি বলে ঘুরে বেড়াতে লাগলেন। চারদিন তিনি ওড়াকান্দি ভক্তগণের গৃহে অবস্থান করার পর রাউৎ খামার রামচাঁদের গৃহে গমন করলেন। রামচাঁদ হরিচাঁদকে হরিজ্ঞান করে তাঁর চরণে আত্মসমর্পণ করে বসে আছেন। ভক্তাধীন প্রভু ভক্তের একান্ত ভক্তিতে বাধ্য হলেন। সেখানে রামচাঁদের গৃহে শ্রী বংশীবদন, রামসুন্দর, বাসীরাম, কাশীরাম এঁরা সকলে হরিচাঁদের ভক্ত হলেন। তখন বালাদের গৃহে প্রভু নামে প্রেমে মত্ত হয়ে দু’দিন অবস্থান করলেন। বালারা স্বগোষ্ঠী হরিচাঁদের চরণে আত্মসমর্পণ করে ধন্য হলেন। হরিকথা প্রেমানন্দে নামে গানে প্রেমের জোয়ারে গ্রাম যেন ভাসতে লাগল। হাটে মাঠে ঘাটে সর্বত্র রটনা হয়ে গেল যশোবন্ত পুত্র হরিচাঁদ ঠাকুর হয়েছেন। তাঁর মুখের কথায় ব্যাধি আরোগ্য হয়। এইকথা বায়ুবেগে সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ল। দুরান্ত থেকে স্রোতের মত ব্যাধিযুক্ত মানুষ ছুটে আসতে লাগল। হরিচাঁদের কাছে গেলে তিনি তাঁকে কীর্তনের ধুলি অঙ্গে মাখতে বলেন। সেই রোগগ্রস্ত ব্যক্তি হরিচাঁদের আদেশে সংকীর্তন ভূমিতে গড়াগড়ি দিয়ে আকুল হয়ে কাঁদতে থাকে। হরিচাঁদের কি অপার মহিমা! সেই ব্যাধিগ্রস্ত ব্যক্তি কখন যে ব্যাধিমুক্ত হয় সে নিজেই জানে না। শুধু একসময় সকলে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে দর্শন করেন যে, সেই ব্যক্তি সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে ভক্তদের সঙ্গে উদ্দণ্ড কীর্তন করে চলেছেন। এমনি ভাবে বহুলোক ব্যাধিমুক্ত হতে লাগলেন। রোগগ্রস্তরা কেহ কেহ মনে মনে মানত করলেন, হে হরিচাঁদ, ব্যাধিমুক্ত হলে আমি তোমার কীর্তন স্থলে হরিলুট দেব। কেহ গায় ধুলি মাখেন, কেহ দুই বাহু তুলে নৃত্য করেন, কেহবা হরিচাঁদের চরণ ধরে কাঁদতে থাকেন। প্রভু নিজে কখনো ভাবোন্মত্ত হয়ে ভক্তদের সঙ্গে কীর্তন করেন আবার কখনো কেঁদে কখনো হেসে নানা ভাব ধারণ করে হরিকথা কৃষ্ণ কথায় পরমানন্দে দিন রজনী যাপন করতে লাগলেন, আবার কখনো তিনি আসন গ্রহণ করে শান্ত ভাবে ভক্তদের কীর্তন দর্শন করেন। তিনি যেভাবেই থাকুন না কেন দূরাগত নরনারীর আসার বিরাম থাকে না। কত রোগী ভোগী এসে ঠাকুর হরিচাঁদের চরণ ধরে রোদন করতে থাকে। কেহ এসে কেঁদে পড়ে, বাবা, আমার ব্যাধি নিরাময় হলে আমি তোমার দাস হয়ে থাকবো। আবার কেহবা ভক্তি গদ্‌গদ্‌ ভাবে বলতে থাকে, হে প্রভু, আমার ব্যাধি সারুক বা না সারুক আমাকে তোমার চরণে ঠাঁই দাও, আমাকে তোমার দাসানুদাস কর। অনেকেই মানত করে রাখে, হে হরিচাঁদ, আমি ব্যাধি মুক্তি হলে কিছু তাম্র মুদ্রা তোমার চরণে এনে দেব। কেহ পাঁচসিকা কেহ সোয়া আনা, কেহ সোয়া পাঁচ আনা এইভাবে যার যার সাধ্য মত মানত করেন। তারপর রোগে আরোগ্য হয়ে তাঁরা মানতের অর্থ ঠাকুরের চরণে এনে সমর্পণ করেন। হরিচাঁদ সেই অর্থ স্পর্শ করেন না, তাই দেখে ভক্তগণ সেই অর্থ নিজেদের কারও কাছে গচ্ছিত রাখেন।
শ্রীমতী মীরা হালদারের ‘শ্রী শ্রী হরিলীলা কথামৃত’ থেকে