দীপান্বিতা বা দীপাবলি অমাবস্যা তিথি আশ্বিন মাসে মহাশক্তি শ্রীশ্রীদুর্গামাতার মহাপূজা ও লক্ষ্মীপূজার পর কার্তিক মাসে প্রতি বৎসর উপস্থিত হইয়া ভারতবর্ষে হিন্দু নরনারীর মধ্যে বিপুল উৎসাহের সঞ্চার করে। এই তিথিতে দিবাভাগে পিতৃপুরুষের শ্রাদ্ধতর্পণ এবং রাত্রিকালে মহামায়া শ্রীশ্রীকালিকা মাতার পূজা এবং দেশ ভেদে নূতন খাতা উৎসব ব্যাপকভাবে আলোকসজ্জা প্রভৃতি অনুষ্ঠিত হয়। হিন্দুদর্শনে পরলোকগত পৃর্বপুরুষের তর্পণাদি তাৎপর্যপূর্ণ। ইহার মন্ত্রসমূহের ভাবার্থ মৃত পিতামাতার উদ্দেশে প্রগাঢ় শ্রদ্ধা এবং তৎসহ বিশ্বের স্থাবর জঙ্গম প্রভৃতি সকল আধারে যেখানে যত ধার্মিক বা পাপী আত্মা আছেন তাঁহাদের সহিত তর্পণকর্তার কোনও কালে কোনও দৈহিক ছিল বা ছিল না, আছে বা নাই অথবা ভবিষ্যতে থাকিতে বা থাকিতে না-পারে সকল আত্মার তৃপ্তি ও আনন্দের জন্য জলাঞ্জলি ও পিণ্ডাদি প্রদত্ত হয়। এই বিশ্বাত্মতর্পণের জন্য উদার চিত্তপ্রসারতা একমাত্র হিন্দুধর্মেই আছে। ভক্তগণ পিতৃপুরুষ ও বিশ্বের সকল আত্মার কল্যাণের জন্য গীতাভাগবতাদি ভক্তিগ্রন্থ ও উপনিষদ পাঠ করেন এবং ঈশ্বরের নাম জপসংকীর্তনাদি করেন। যাঁহারা জন্মান্তর পরলোক জীবাত্মার নিত্যত্ব অমরত্ব ও ঈশ্বরের অস্তিত্বে বিশ্বাসী তাহাদের সকলেই একমত যে, যে-সকল পূর্বপুরুষের কৃপায় আমরা মানব জন্মলাভ করিলাম তাঁহাদের প্রতি সর্বাগ্রে শ্রদ্ধা আবশ্যক। আমাদের সকল শাস্ত্র বলেন যে, পিতামাতার প্রতি অকৃতজ্ঞ ও শ্রদ্ধাহীন ব্যক্তির পূজা ঈশ্বর গ্রহণ করেন না। সেইজন্য উপদেশসমূহের সর্বাগ্রে উপনিষদ বলিয়াছেন, ‘‘মাতৃদেবো ভব পিতৃদেবো ভব’’। মহালয়া অমাবস্যার ন্যায় দীপান্বিতাও পিতৃপূজার একটি শ্রেষ্ঠ তিথি।
দিবাভাগে পিতৃলোকের পূজায় পবিত্র হইয়া রাত্রির ঘোর অন্ধকারের মধ্যে জ্যোতির্ময়ী ব্রহ্মশক্তি শ্রীশ্রীকালীমাতার আরাধনায় ভক্ত নিবিষ্ট হয়েন। অমানিশার নিবিড় তিমিররাশির মধ্যে মহামেঘবর্ণা জগজ্জনীর ধ্যান অর্চনা করেন মাতৃসাধকগণ কিন্তু কোটি সূর্য সমুজ্জ্বলা আবার কোটি চন্দ্র সুশীতলা বিশ্বমাতার ব্রহ্মচৈতন্যের অনুপম জ্যোতিতে তাঁহাদের হৃদয়ের সকল অন্ধকার অজ্ঞান তমোরাশি চিরতরে বিদূরিত হইয়া যায়।
তাঁহারা হন আত্মজ্যোতিঃ আত্মারাম আত্মতৃপ্ত। দীপান্বিতার রাত্রিতে চতুর্দিকে প্রদীপাদি প্রজ্বালন এবং বিবিধ আলোকের ঘটা সেই
জ্যোতির্ময়ী মহাজননীর দিব্যালোক-প্রভায় সাধকের অন্তঃস্থলে দিব্যজ্যোতি প্রকাশেরই একটি প্রতীক বা বাহ্যরূপ।
পণ্ডিতপ্রবর জ্যোতির্ময় নন্দের রচনা থেকে