বাধা ও অসফলতার জন্য চিন্তা। মানসিক টানাপোড়েনের মধ্যে কোনও ভালো যোগাযোগ পেতে পারেন। ... বিশদ
আর একদিনের কথা। শ্রীঠাকুরের শ্রীমুখ থেকে উচ্চারিত হল,—মুখটা কেমন করছে, পাকা আমলকী খাব। দীনধন্য নাগমহাশয় ছিলেন যুক্তকরে দাঁড়িয়ে ধীর শান্ত তপোজ্জ্বল বুকে এই বেদবাণী হারায় না তার দিশা। ধীর নিস্তব্ধ সঞ্চারে চলে যান দুর্গাচরণ—তিন দিন অনাহারে অতন্দ্র চেষ্টায় খুঁজে পান পাকা আমলকী—পরম যত্নে পরম আনন্দে নিয়ে আসেন শ্রীঠাকুরের শয্যাপাশে—সেটা ছিল পাকা আমলকীর অসময়। শ্রীঠাকুর প্রসন্ন হাসিতে গৃহকোণ উচ্ছ্বসিত করে বললেন, আহা!—এমন পাকা আমলকী কোথায় পেলে দুর্গাচরণ?—দীনভক্ত লুণ্ঠিত বুক পেতে গ্রহণ করেন সে প্রসন্ন হাসির অস্তরেখ।
শ্রীঠাকুরের ভক্তদের কাছে এই দীন ভক্তের পরিচয় ছিল অতিক্ষীণ। তিনি অতি অগোচরে, অতি অপরিচয়ে যেতেন দেবসান্নিধ্যে—গৃহকোণে দেখা যেতো—শুষ্ক মলিন জীর্ণবাসে, যুক্ত করে আছেন বসে সকলের পশ্চাতে। শুধু দীপ্ত নয়নে জেগে থাকত তপস্যায় শিখাঞ্জন।
লীলাপোষ্টাইয়ের হাজরা সেদিন দক্ষিণেশ্বরে আছেন বসে—মধ্যমণি হবার সাধ তাঁর চিরদিনই ছিল। দীনবেশে নাগমহাশয় গেছেন দক্ষিণেশ্বর-ধামে—বহুবঞ্চিত বহুবাঞ্ছিত আশা আকাঙ্খার অরূণিমা নিয়ে। প্রথম দর্শনের সেই অতি গহিনক্ষণে অভাগ্যে দেখা হয় হাজরা মহাশয়ের সঙ্গে—তিনি দেন না কোন দিশা, বলেন,—পরমহংসমশায় এখানে নাই। নাগমহাশয় আশাভঙ্গে হয়ে পড়েন শেলাহত—সহসা দীনের ঠাকুর দেন দর্শন—ভাবমাত্র আবরণ, অর্ধবাহ্যে ডেকে নেন দিব্য অতি পবিত্র এই সন্তানকে। নাগমহাশয় বলতেন—ফুট তাঁর হাতে, ধরা না দিলে কি ধরা যায়? শ্রীঠাকুরও গাইতেন,—ওরে কুশী-লব, কি করিস গৌরব, ধরা না দিলে কি পারিস্ ধরিতে—নাগমহাশয় সেই একদিনেই ধরতে পেরেছিলেন শ্রীঠাকুরকে, আর জীবনে কখনো ভুল হয় নি তাঁর এই জানাজানি অধরাকে ধরতে পারা...
দীনহীন এই ভক্তটির আর একটি দিক ছিল। সেখানে তিনি বজ্রাদপি কঠোর হতে পারতেন। সেবার দেওভোগে প্রতিপত্তিশালী দুইজন সাহেব শিকারে যান। এঁরা সেকালের কর্ত্তা বিশেষ। কারো কোন আপত্তি শুনবার প্রবৃত্তি এঁদের কোন দিনই ছিল না। যাই হোক এঁরা যখন শিকারে উদ্যত, তখন নাগমশায়ের চোখে পড়ে তাঁদের এই নিষ্ঠুর চেষ্টা। তিনি যুক্তকরে তাঁর সহজ সুলভ দীনতায়, নিষেধ করেন তাঁদের এই হত্যালীলা। তাঁরা দৃকপাতহীন কৃপা দৃষ্টিতে তুলে ধরেন অগ্নিঅস্ত্র। সহসা অনাহারে খিন্নশরীর নাগমহাশয়ের দেহে জাগে একটা প্রবল বিক্রম। তিনি সাহেবের হাত থেকে আগ্নেয় অস্ত্রটি নেন কেড়ে। সাহেবেরা অপ্রত্যাশিত আক্রমণে হয়ে পড়েন হতবুদ্ধি—কিন্তু সম্বিৎ ফিরে পেয়ে নাগমহাশয়ের বিষয় জেনে আর কিছু উচ্চবাচ্য করেননি।
আর একবারের কথা, নাগমহাশয়ের কাছে গ্রামের জমিদার শ্রীঠাকুরের নামে কিছু কটু বলেন। নাগমহাশয় ত্রস্ত দীনতায় তাঁকে নিরস্ত হতে বলেন। তিনি কিন্তু ভুলবার পাত্র ছিলেন না। সহসা এক অভাবনীয় ঘটনা যায় ঘটে। নাগমহাশয় তখন উদ্যত রোষে তাঁকে প্রহারে উদ্যত হন। এতে কিন্তু বিপত্তির সম্ভাবনা ছিল। জলে থেকে কুমীরের সঙ্গে এই বিবাদের সাহস কঠিন কথা।