পুরনো রোগ চাগাড় দেওয়ায় দেহকষ্ট ভোগ করতে হতে পারে। তীর্থ ভ্রমণ ও ধর্মকর্মে আত্মিক তৃপ্তিলাভ। ... বিশদ
এই জগতই তাহার রঙ্গভূমি, লীলাময় এই স্থানেই অভিনয় করিতেছেন। আমরা যেমন আপনাদের গৃহের ভিতর বসিয়া সূর্যালোককে মনে করি যে, আমার বাটিতে উহা আবদ্ধ হইয়া আছে, সেইরূপ সাম্প্রদায়িক ভাবরূপ প্রাচীর দ্বারা আমরা বাহিরের ভাব কোন মতে উপলব্ধি করিতে পারি না। নিজ বাটির বাহির হইয়া প্রত্যেক বাটিতে প্রবেশপূর্ব্বক তথাকার রৌদ্র এবং সূর্য্য জ্ঞান লাভ করিতে পারিলে, সর্ব্বশেষে তাহার সমন্বয় হইতে পারে। তখন তাহার এক সূর্য্য জ্ঞান ও তাহার রশ্মি সর্ব্বব্যাপী বলিয়া বিজ্ঞান বা প্রত্যক্ষ হইবার সম্ভাবনা। ধর্ম্ম-সমন্বয়ও সেইরূপ। প্রত্যেক ভাবে সাধক সিদ্ধ হইয়া, তদনন্তর তাহার সমন্বয়কালে তিনি দেখিতে পান যে, এক ঈশ্বর এবং তাঁহারই বহু ভাব। মনুষ্যের দ্বারা তাহা অদ্যাপি সাধিত হয় নাই; সেইজন্য দ্বেষভাবের সম্প্রদায়িক ভাবের অবিরত অভিনয় হইতেছে।
দয়াময় ভগবান রামকৃষ্ণ-রূপে তাহা কার্য্যে পরিণত করিয়া, ধর্ম্মের সমন্বয় করিয়া দিয়া গিয়েছেন। মনু্ষ্যের দ্বারা যাহা হয় নাই, কখন হইবেও না, তাহা রামকৃষ্ণের দ্বারা হইয়াছে, এই নিমিত্ত তাঁহাকে অবতার বা পূর্ণব্রহ্ম ভগবান বলিয়া আমরা বুঝিয়াছি। রামকৃষ্ণদেব যে, বাস্তবিক ধর্ম্ম-সমন্বয় করিয়াছিলেন, তাহার প্রত্যক্ষ প্রমাণ দিতেছি। তাঁহাকে সকল সম্প্রদায়ের লোকেরা নিজ নিজ ইস্ট বলিয়া বুঝিতে পারিতেন। পরমহংসেরা তাঁহাকে ‘পরমহংস’ জ্ঞান করিতেন এবং তজ্জন্যই সেই নামে ‘রামকৃষ্ণ পরমহংস’ বলিয়া অদ্যাপি উল্লিখিত হইতেছেন। তান্ত্রিক কৌলেরা তাঁহাকে ‘কৌল’ বলিয়া মানিতেন, বৈষ্ণবেরা তাঁহাকে গৌরাঙ্গ স্বীকার করিতেন, শৈবেরা শিব বলিয়া বুঝিতে পারিতেন, নানকপন্থীরা নানক, কর্ত্তাভজারা আলেখ, সহজেরা সহজ, বাউলেরা সাঁই, নবরসিকেরা অটুট বলিয়া বুঝিতে পারিতেন। এমন কি বর্তমান কালের ব্রহ্মজ্ঞানীরাও তাঁহাকে জ্ঞান ভক্তির আদর্শ স্থান বলিয়া তাঁহার চরণপ্রান্তে যাইয়া আশ্রয় লইতেন। তাঁহার নিকট একদিকে সকল সম্প্রদায়ের সাধুরা উপবেশন করিতে পাইতেন, আর একদিকে সরল অকপট মাতাল, লম্পট, বেশ্যাসক্ত ব্যক্তিরাও স্থান পাইতেন। কেবল কপট আত্মাভিমানী ব্যক্তিরা এক মুহূর্ত্তকাল বসিতে পারিতেন না।
রামকৃষ্ণের নিকটে যখন সকল শ্রেণীর লোকেরা, সাধু, অসাধু, সন্ন্যাসী, গৃহী, নরনারী, বৃদ্ধ, যুবা, বালক, সকলেই শান্তি পাইতেন, যখন তাঁহাকে নিজ নিজ ভাবে হৃদয়ে ধারণ করিতে পারিতেন, সকলে তাঁহাকে ইষ্ট বলিয়া বোধ করিতেন, এমন ব্যক্তি যিনি, তিনি কে? স্থির হইয়া, যদ্যপি বুঝিব বলিয়া বুঝিতে কেহ চেষ্টা করেন, তিনি অবশ্যই বুঝিতে পারিবেন যে, রামকৃষ্ণদেব বাস্তবিক অবতার-রূপে অবতীর্ণ হইয়াছিলেন। তাঁহার ধর্ম্মসমন্বয়-কাহিনী হইয়া আমরা যদ্যপি একদণ্ড বিচার করিয়া দেখি, তাহা হইলে আমাদের প্রাণে অসীম আনন্দোদয় হইবে, তাহার সংশয় নাই।
যিনি সিদ্ধ, তাঁহার কথা স্বতন্ত্র; যিনি সাধক, তাঁহার কথা স্বতন্ত্র।
‘মহাত্মা রামচন্দ্রের বত্তৃতাবলী’ (১ম ভাগ) থেকে