বাধা ও অসফলতার জন্য চিন্তা। মানসিক টানাপোড়েনের মধ্যে কোনও ভালো যোগাযোগ পেতে পারেন। ... বিশদ
পৃথিবীর অধিকাংশ জাতিই আর্য-সংস্কৃতির কাছে ঋণী। সিংহল, ব্রহ্মদেশ, শ্যাম, কম্বোজ, কোচিন, মালয়, যবদ্বীপ, বালী, সুমাত্রা, চীন, জাপান, কোরিয়া— যেকোন জাতিরই ইতিহাস খুলে দেখি না কেন, সর্বত্রই এক কথা। তাঁদের ধর্ম তাঁদের সংস্কৃতি এই আর্য-সভ্যতার দ্বারাই অনেকাংশে পুষ্ট, সুদূর মেক্সিকো, গ্রীস এবং রোমেও যে এই ধারা পৌঁছেছিল, তার নিদর্শনেরও অভাব নেই।
এই আর্যধর্মের শাশ্বত অনুশাসনের মধ্যেই প্রথম মানব-সভ্যতা ও সমাজ-সংস্কৃতির সনাতন রূপটি সার্থকরূপে ধরা পড়েছিল। সত্যদ্রষ্টা আর্যঋষির তপঃস্নিগ্ধ অনুশাসন মানুষের বহির্মুখী ও অন্তর্মুখী উভয়বিধ উন্নতি বিধান ও সমাজ ব্যবস্থার কার্য রূপায়ণের জন্য কার্যকরী হয়েছিল। আবার তা অন্য ধর্ম বিদ্বেষী নয়, বরং সমন্বয় ধর্মী, এই জন্যেই ভারতীয় সংস্কৃতি সর্বত্র সমাদর পেয়েছে।
বিভিন্ন ধর্ম ও সংস্কৃতির সমন্বয়ের বাণী প্রচারই আর্য সভ্যতার মূল সুর। যখন মিশর, ব্যাবিলন প্রভৃতি দেশ পরস্পরের মধ্যে ধর্মের যথার্থ রূপ এবং দেব দেবীর যথার্থ প্রকৃতি নিয়ে বিবাদে মত্ত, তখনই ভারতের তপোবন থেকে উচ্চারিত হয়েছিল সেই সনাতন মহাবাণী ‘একং সদ্বিপ্রাঃ বহুধা বদন্তি।’ অর্থাৎ ব্রহ্ম এক। ঋষিগণ নানাভাবে বলে থাকেন।
মানব সভ্যতার ঊষাকালে হয়তো পৃথিবীর অনেকদেশেই সমাজ-সভ্যতা-সংস্কৃতি-ধর্মের বিকাশ হয়েছিল, কিন্তু তা আজ ইতিহাসের উপকরণ মাত্র, এক মাত্র ভারতবর্ষই তার ‘সনাতন সত্য’কে চিরকাল বহন করে চলেছে। কারণ তা ব্যক্তিবিশেষের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত নয়। ইহা চিরন্তন।
বহিরাক্রমণ, রাজনীতিক সংঘাত, অর্থনীতিক বিপর্যয় কোন কিছুই ভারতের এই প্রাণমন্দাকিনীর গতিরোধ করতে পারে নি। আপাত দৃষ্টিতে জাতির অবিরাম চলার ছন্দ হয়তো কখনও ব্যাহত হয়েছে, হয়তো বা আর্যসমাজ বন্ধন কখনও হয়ে পড়েছে শিথিল কিন্তু তাতে কি আসে যায়। সংগে সংগে আবির্ভূত হয়েছেন কোন মহামানব। দূর করে দিয়েছেন বহির্জীবনের সমস্ত ক্লেদ-গ্লানি। সব কিছুরই হয়ে গিয়েছে সুষ্ঠু সমাধান।
ধর্মবিষয়ে ভারতের স্থান সুউচ্চে; কিন্তু এর জন্য তার কোন বল প্রয়োগের প্রয়োজন হয় নি। সনাতন ধর্মের অবিসংবাদিত উৎকর্ষ তাকে দিয়েছে নব নব সম্ভাবনাময় সৃষ্টির প্রেরণা। আপাতঃ দৃষ্টিতে বহিরাক্রমণ ভারত সংস্কৃতির পরিপন্থী মনে হলেও, তা মূলতঃ ভারতীয় সভ্যতার বিশেষ কোন ক্ষতি করতে পারে নি। ভারতীয় সংস্কৃতি খুব ব্যাপক। কি সাহিত্য, কি শিল্প, কি ভাস্কর্য, কি দর্শন, কি ইতিহাস, কি বিজ্ঞান, কি ভেষজশাস্ত্র সর্বক্ষেত্রেই বহু প্রাচীন কাল থেকে ভারতীয়গণ অত্যশ্চর্য কৃতিত্ব দেখিয়েছিল। গৌতম, কনাদ, পতঞ্জলি, শংকরাচার্য, কপিল রামানুজের মতো দার্শনিক; ব্যাস, বাল্মীকি, ভবভূতি; কালিদাসের মত অমর কবি; জীবক, চরকাদি চিকিৎসক; আর্যভট্ট, ভাস্করাচার্য, ব্রহ্মগুপ্তের মতো বৈজ্ঞানিক, মানব সভ্যতার ইতিহাসে চির ভাস্বর।
সনাতন ধর্মের বিপর্যয়ের লগ্নে আবির্ভূত হয়েছেন শ্রীরামচন্দ্র, শ্রীকৃষ্ণ,বুদ্ধ, রামকৃষ্ণ প্রমুখ মহাপুরুষেরা। নূতন করে জানিয়ে দিয়েছেন যুগবাণী। দেখিয়ে দিয়েছেন পথ! গীতায় শ্রীকৃষ্ণ তাই বলেছেন—হে ভারত, যখন প্রাণিগণের অভ্যুদয় ও নিঃশ্রেয়সের কারণ বর্ণাশ্রমাদি ধর্মের অধঃপতন ও অধর্মের অভ্যুত্থান হয়। তখন আমি স্বীয় মায়াবলে যেন দেহবান হই, যেন জাত হই।