খেত্‌রী মহারাজার সহিত যোগাযোগ স্বামীজীর জীবনের এক উল্লেখযোগ্য ঘটনা। নানাভাবে এই ঘটনা স্বামীজীর ভবিষ্যৎ কর্মসূচীকে প্রভাবান্বিত করে, এক নূতন বাঁকে তাঁহার কর্মস্রোতকে চালিত করে। এখানে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য যে খেত্‌রীতেই মহারাজার অনুরোধে স্বামীজী তাঁহার অমর ‘বিবেকানন্দ’ নামটি গ্রহণ করেন। এ-নাম আর কোনদিন তিনি বর্জন করেন নাই। ইহা সর্বজনবিদিত যে শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেব তাঁহার শিষ্যবর্গকে শাস্ত্রীয়মতে দীক্ষা দেন নাই অথবা তাঁহাদের গার্হস্থ্যাশ্রমের নাম পরিবর্তন করিয়া সন্ন্যাসাশ্রমের নাম দেন নাই। মহান গুরুর তিরোধানের পর তাঁহার ভাব-প্রভাবিত যুবকেরা বরাহনগরে একটি বাসায় সমবেত হন। পরে ইহাই বরাহনগর মঠ নামে পরিচিত হয়। নরেন্দ্রনাথের নেতৃত্বে তরুণেরা সেই গৃহে শুদ্ধাচারী সাধনামগ্ন জীবন যাপন করিতেছিলেন। এইখানেই সন্ন্যাসব্রত গ্রহণ করিয়া সঙ্ঘবদ্ধ সতীর্থগণ রামকৃষ্ণ আশ্রমের ভিত্তি সুদৃঢ় করেন, পবিত্র ‘বিরজা’ হোম পালনার্থে চিরকৌমার্য, দারিদ্র্য এবং ভগবৎসেবা ও মানবসেবার জন্য আত্মোৎসর্গের কঠোর শপথ গ্রহণ করেন। কোন গুরুর প্রয়োজন হইল না, আপনাদিগকে আপনারাই পূর্ণাঙ্গ সন্ন্যাসধর্মে দীক্ষিত করিলেন। বস্তুতঃ কোন গুরুর প্রয়োজন তাঁহারা বোধ করেন নাই, কারণ মহান গুরু শ্রীরামকৃষ্ণের জীবিতকালে বহু শিক্ষাই তাঁহারা লাভ করিয়াছিলেন এবং শিষ্যদের প্রতিপদক্ষেপ সৎপথে চালিত করিবার জন্য প্রভুর আশীর্বাদ যে সদাজাগ্রত, এই নির্ভরতা তাঁহাদের ছিল।
জীবনের এই সন্ধিক্ষণে তরুণ ভক্তগণ স্ব-স্ব নাম পরিত্যাগ করিয়া নূতন নাম গ্রহণ করিলেন, পূর্বাশ্রমের সহিত সকল বন্ধন ছিন্ন করিলেন। যেমন রাখাল হইলেন স্বামী ব্রহ্মানন্দ, বরাহনগর মঠের “মা” শশী, হইলেন স্বামী রামকৃষ্ণানন্দ। কিন্তু নরেন্দ্রনাথ তাঁহার পুরাতন নাম বর্জন করিয়াও কোন নির্দ্দিষ্ট নাম লইলেন না। কখনও সচ্চিদানন্দ, কখনও বিবিদিষানন্দ, কখনও বা অন্য কিছু। পরিব্রাজক-বেশে যখন দেশে দেশে ঘুরিতেছেন তখন আত্মগোপনের উদ্দেশ্যে তিনি নানা নামে নিজের পরিচয় দিয়াছেন। দিল্লীতে একবার তাঁহার সতীর্থগণ তাঁহাকে স্বামী বিবিদিষানন্দ রূপে আবিষ্কার করেন। স্মরণ থাকিতে পারে, নরেন্দ্রনাথ বরাহনগর মঠ পরিত্যাগ করিয়া যাওয়ার অন্যান্য সকলে নেতার অভাবে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হইয়া পড়েন। সেইজন্য আশ্রমে কয়েকজন নরেন্দ্রনাথের সন্ধানে স্থান হইতে স্থানান্তরে ছোটেন এবং অবশেষে তাহাকে দিল্লীতে আবিষ্কার করেন। বরাহনগরে ফিরিয়া আসিয়া আশ্রমের নেতৃত্ব গ্রহণ করিবার জন্য সতীর্থগণ কাতর অনুনয়-বিনয় করিলে পর নরেন্দ্রনাথ তাহাদের কঠোর উত্তর দিলেন:
“পূর্বেই বলেছি, আমি একা থাকতে চাই। তোমাদের আমি আবার বলছি, আমার পিছু ধাওয়া তোমরা করো না। আমি এটা পছন্দ করি না। এই আমি দিল্লী ছাড়ছি, কেউ যেন আমার অনুসরণ না করে, কেউ যেন না জানতে চেষ্টা করে কখন কোথায় আমি থাকব। এ আমার আদেশ, তোমাদের পালন করতেই হবে। সব সঙ্গ থেকে ছিন্ন হতে চাই আমি। আত্মা যে-পথ দেখাবে, সেই পথেই ঘুরে বেড়াব। তা সে গহন বন-হোক, ধূ ধূ মরুভূমি হোক, পার্বত্য অঞ্চল অথবা ঘন-বসতি শহরই হোক্‌। আমি চললাম। আমার ইচ্ছা, তোমরা স্ব-স্ব আলোকে গন্তব্যস্থলে পৌঁছবার আপ্রাণ চেষ্টা করো।”