ব্যথার বারাণসী কাশীপুরের অন্যতম ব্রতধারী ছিলেন গঙ্গাধর মহারাজ। অতি শৈশবেই শ্রীঠাকুরের দৃষ্টি-প্রসাদ পেয়েছিলেন এই চিহ্নিত পার্ষদটি। শিশুসুলভ চাপল্যে কখন দেখা যেত শ্রীঠাকুরের চরণে ঘসে ঘসে রক্তিম করে তুলেছেন ললাটদেশ—কখন বা শ্রীগুরু নির্দ্দেশে দেখেছেন ভবতারিণীর চরণে মহেশের নিশ্বাস-স্পন্দিত জীবন্ত দেহ—কোনদিন বা নির্ব্বাক নিষ্পন্দে দেখেছেন শ্রীঠাকুরের নটভঙ্গরূপ—জগজ্জননীর চরণে প্রার্থনারত বিরাট শিশুর অসীম কাঁদনি—শ্রীঠাকুরের সেই আকুল কাঁদনই সূত্র হয়ে দাঁড়ায় সেবাব্রতী স্বামী অখণ্ডানন্দের জীবনে। সেদিন খেত্ড়ী-রাজধানীতে ঘনিয়ে এসেছে একটি রূপরম্য মধ্যাহ্ন—খেতড়ী প্রাসাদ সংলগ্ন সরোবর কূলে জমে উঠেছে রাখীবন্ধনের রাজ-সমারোহ—উৎসবে এসেছেন রাজা অজিত সিংহ আর তাঁর অমাত্যবৃন্দ। সহসা এসে দাঁড়ান স্বামিপাদ, পরিব্রাজকের বেশে, তিনি তখন খেতড়ীর অতিথি—নয়নে বেদনোদ্বেল অশ্রুধারা—মহারাজকে জানান দুঃখের কাহিনী—তাঁর বহু আয়াসে গড়ে তোলা গোলাবালকদের বিদ্যাপীঠটি মহারাজের আদেশেই নাকি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে আর তাই সন্ন্যাসী খেতে খেতেই এসেছেন ছুটে প্রতিকার। মানসে। দুর্ভিক্ষের মাঝে মহুলার অন্নদান ব্রতের মূলেও ছিল অন্তরের এই আকুল ক্রন্দন...সারগাছির অনাথ আশ্রমও এই অন্তরের আবেদনে আজও হয়ে আছে প্রাণময়। আর তাঁর সেই সেবামূর্তিই প্রকাশিত হয়েছিল আলামবাজার মঠে যেদিন শ্রীঠাকুর দেখা দেন, নব-নীল-নীরদ-কান্তি গোপাল মূর্তিতে আর নিজের স্বরূপ প্রকাশিত হয় যশোদার মাতৃমূর্তিতে। ঘটে ঘটে এই বালগোপালের সেবাকেই বুকে করে নিয়েছিলেন। ঠাকুরের দ্বাদশ দিকপালদের মধ্যে খোকা মহারাজ সবচেয়ে ছোট। কাশীপুরের সেবায়তনে সরল প্রাণের আকুলতায় ঔষধ হিসাবে চায়ের ব্যবস্থা ইনিই দেন। রাখাল মহারাজের নিষেধে শ্রীঠাকুরের সেটির আর প্রয়োজন হয়নি।
দুইজনের জীবনে ঈশ্বর দর্শনের প্রশ্নটি পরম হয়েই প্রকাশ পেয়েছিল। একজন শিবাবতার বিবেকস্বামী আর একজন এই সুবোধানন্দজী। শ্রীঠাকুর দিয়েছেন সেই একই উত্তর—দুইজনে একসঙ্গে থাকলে যেমন দেখা যায় সেই রকম সহজ দর্শনেই সাধক হন ধন্য তবে তার জন্যে চাই কান্না—ছেলে যেমন বুক ফাটা কান্না কাঁদে মার জন্যে। লুপ্তধারা ফল্গুবুকে সেদিন হঠাৎ জাগে মুক্তির উচ্ছ্বাস। সুবোধ মহারাজ চলেছেন অপর পারে। সহসা দুটি হাতে প্রণতি ওঠে জেগে আসন্ন সলিল সমাধিতে তখন তিনি পরপারের যাত্রী—তবে সে ডাক তখনও আসেনি। কে যেন তাঁকে তুলে ধরে তরঙ্গের ওপরে। অশরণের শরণ শ্রীঠাকুরই হয়তো ধরেছিলেন সেই শেষ শরণের দুটি হাত। অসময়ে সে প্রণাম ঠাকুর দিয়েছিলেন ফিরিয়ে। হরিদ্বারে সেবার বেদনা জর্জর দেহে ধরেছেন তৃষ্ণার পূর্ণপাত্র কমণ্ডুল, কম্পিতহাত থেকে স্খলিত হয়ে পড়ে যায় সে জলপাত্র অন্তর মথিত অভিমানে জানান শ্রীঠাকুরকে। নিমিলিত নয়নসমক্ষে, স্নিগ্ধ বেশে এসে দেখা দেন শ্রীঠাকুর—জুড়িয়ে যায় সব ব্যথা। মৌন মন্থরে দুটি কথা ওঠে জেগে। আর কিছুই চাই না ঠাকুর, তোমায় না ভুলি! অন্তর্যামীর কাছে অন্তরের এই প্রার্থনা হারায়নি কোনদিন।
শ্রীঠাকুরসত্যানন্দের ‘রচনাবলী’(১ম খণ্ড)থেকে