ঝগড়া এড়িয়ে চলার প্রয়োজন। শরীর স্বাস্থ্য বিষয়ে অহেতুক চিন্তা করা নিষ্প্রয়োজন। আজ আশাহত হবেন না ... বিশদ
মানুষ ক্ষমতাকে ভালবাসে, তাই ত সে দুর্ব্বলতার অধীন। কারণ শক্তির যত তরঙ্গরাজি পরস্পরের সাথে এসে মিলিত হয়, পরস্পরের উপর নিরন্তর প্রতিহত হয়, তাদের নিয়ে যে এক সাগর তাই হল জগৎ। কোন তরঙ্গের শিখরে যে আরোহণ করবে, তাকে আর শত তরঙ্গের আঘাতে অভিভূত হতে হবে। মানুষ ভালবাসে সুখ, তাই ত তাকে শোকের বেদনার ভার বহন করতে হয়। কারণ, অমিশ্র আনন্দ কেবল মুক্ত রাগবর্জ্জিত অন্তঃপুরুষের জন্য; মানুষের মধ্যে সুখের অন্বেষণ করে চলে যে বস্তু তা হল একটা দুঃখভাগী কৃচ্ছ্রপ্রয়াসী কর্ম্মশক্তি।
মানুষের ক্ষুধা প্রশান্তির জন্য, তবে, সেই সঙ্গেই আবার চঞ্চল মনের আর উদ্বেল হৃদয়ের অভিজ্ঞতা লাভ করবার তৃষ্ণাও তার আছে। মন ভোগ বলতে বোঝে তীব্র বিক্ষোভ, আর প্রশান্তি তার কাছে জড়তা ও বৈচিত্র্যশূন্যতা।
মানুষ ভালবাসে তার দৈহিক সত্তার সসীমতা, তবুও সে চায় আবার তার অসীম মন আর অমর আত্মার অবাধ মুক্তি।
মানুষের ভিতরে একটা কি জিনিষ আছে যা এই সব বৈরূপ্যের মধ্যে পায় এক বিচিত্র রস। তার মনোনয় সত্তা এ সকলকে জীবনের কারুকার্য্য হিসাবে গ্রহণ করে। কেবল অমৃত নয় বিষও তার রসনাকে, তার কৌতূহলকে আকৃষ্ট করে।
এ সকল জিনিষেরই অর্থ আছে। এ সকল বিরোধ থেকেই মুক্তি লাভ করা যায়। প্রকৃতির যোগাযোগ যতই খেয়ালী হোক তার মধ্যে একটা পদ্ধতি রয়েছে, তার গ্রন্থি যত জটিল হোক, মীমাংসা তার আছে।
জীবনের কাছে প্রকৃতি নিরন্তর যে প্রশ্ন করে চলেছে, তারই নাম মৃত্যু। মৃত্যুর ভিতর দিয়ে প্রকৃতি জীবনকে স্মরণ করিয়ে দেয় যে জীবন এখনও নিজেকে পায় নাই। মৃত্যু আক্রমণ যদি আদৌ না থাকত জীব তবে একটা অসম্পূর্ণ জীবনযাত্রার কাঠামে চিরকাল আবদ্ধ হয়ে থাকত। মৃত্যু তাকে অনুসরণ করে চলেছে বলেই ত জীব একটা সর্ব্বাঙ্গসুষ্ঠু জীবনের আদর্শ সম্বন্ধে সচেতন হয়ে উঠছে, আর তার উপায় এবং কি ভাবে সম্ভব তার আবিষ্কার চলেছে। দুর্ব্বলতাও ঠিক সেই একই পরীক্ষা, একই প্রশ্ন নিয়ে এসেছে, আমাদের গৌরব যত সামর্থ্য বীর্য্য মহত্ত্ব তাদের কাছে। শক্তি হল জীবনের লীলা, শক্তি মাপ করে দেয় জীবনের মাত্রা, নির্ণয় করে জীবনের আত্মপ্রকাশের মূল্য। দুর্ব্বলতা হল মৃত্যুর লীলা—মৃত্যু জীবনের গতি অনুধাবন ক’রে, জীবনের শক্তিসঞ্চয়ের সীমা নির্দ্দেশ ক’রে চলেছে।
দুঃখ ও সন্তাপের ভিতর দিয়ে প্রকৃতি জীবকে স্মরণ করিয়ে দেয় যে তার সকল সুখভোগ হল অস্তিত্বের সত্যকার আনন্দের একটা অস্পষ্ট ইঙ্গিত। আমাদের সত্তার প্রত্যেক বেদনা ও যাতনার মধ্যে তাদের গূঢ়রহস্যরূপে রয়েছে এক তীব্রানন্দের শিখা—এর তুলনায় আমাদের বিপুলতম সুখভোগও যেন আলোর স্তিমিত-আভা। এই গূঢ় রহস্যটির জন্যই কঠোর অগ্নিপরীক্ষা, যন্ত্রণা, নিদারুণ অভিজ্ঞতা সকলের উপর অন্তঃপুরুষের একটা আকর্ষণ রয়েছে, যদিও এ সবকে আমাদের স্নায়বিক মানস-সত্তা পরিহার করে চলে, তাদের স্পর্শমাত্র সহ্য করতে পারে না।
আমাদের কর্ম্মনিরত সত্তা ও তার যন্ত্র সব যে সত্বয়ই শ্রান্ত ও শান্ত হয়ে পড়ে—তা হল প্রকৃতির ইঙ্গিত যে স্থিরতাই আমাদের যথার্থ প্রতিষ্ঠা, উত্তেজনা হল অন্তুঃপুরুষের পক্ষে একটা ব্যাধি। অমিশ্র স্থিরতায় যদি থাকে নিষ্ফলতা ও বৈচিত্র্যশূন্যতা তবে তা দিয়ে প্রকৃতি বুঝাতে চায় যে সেই অচল প্রতিষ্ঠারই উপর আমাদের যাবতীয় কর্ম্মের লীলা হবে, আমাদের কাছে এই তার প্রত্যাশা। ভগবান চির লীলাময়, কিন্তু তিনি উদ্বেগময় নন।
শ্রীঅরবিন্দের ‘চিন্তা-কণা-দৃষ্টি-নিমেষ’ থেকে