অনিঃশেষ সেই আনন্দ, অদম্য সেই শক্তি। সে এক অনন্ত সুখের আকর। ধারণার উচ্চতায়, সুপ্রাচীন জ্ঞানের প্রকাশে, অন্তর্দৃষ্টির গভীরতায়, ধ্যানতন্ময় প্রশান্তিতে, ভক্তির উচ্ছ্বাস ও উদ্দীপনায়, সাধকজীবনের কঠোরতায়, বাণীর মনোহারিত্বে তাঁর জীবনকে সমৃদ্ধ অধ্যাত্মজীবনের বিস্ময়কর উদাহরণ। প্রসারিত দৃষ্টিসম্পন্ন, করুণার বারিধি, এক অতুলীয় বিশ্বতোমুখ প্রতিভার অধিকারী শ্রীরামকৃষ্ণ আধ্যাত্মিক গগনে উজ্জ্বলতম তারকার মতোই দেদীপ্যমান। স্বামীজী বলেছেন, ঠাকুরের নিজের জীবন উপনিষদের এক জীবন্ত ভাষ্য; বলা যায়, উপনিষদের আত্মা যেন মানুষের রূপ ধরে ভারতবর্ষের বিচিত্র ভাবধারার অন্তর্লীন ঐক্যকে তুলে ধরেছে ঠাকুরের মধ্যে। পাশ্চাত্য প্রত্যক্ষবাদে বিশ্বাসী কোনো অজ্ঞেয়বাদী বুদ্ধিজীবীই মরমী সাধকদের আধ্যাত্মিক অভিজ্ঞতাসমূহে বিশ্বাস রাখতে ইচ্ছুক নন। ঈশ্বরদর্শনের নিশ্চিত অভিজ্ঞতা যে যোগী সাধকের নির্ভর, তিনিই পারেন অজ্ঞেয়বাদীর সংশয় ছিন্ন করে তাঁকে ইতিবাচক উত্তর দিতে। শ্রীরামকৃষ্ণ ঈশ্বরকে সামনাসামনি দেখেছিলেন এবং বিবেকানন্দের মনে বিশ্বাস উৎপন্ন করার ক্ষমতা তাঁরই ছিল। খণ্ডকে অখণ্ডকে বলে ভুল করার ফলে অখণ্ড যার আয়ত্তের বাইরেই থাকে, সেই অহংতাড়িত মন ও যুক্তিতর্কের প্রতিস্পর্ধা অগ্রাহ্য করে সত্য সবসময় অবিচল হয়ে অবস্থান করে। যখন আমরা শ্রীরামকৃষ্ণের মধ্যে অতুলনীয় এবং অভূতপূর্ব এক আধ্যাত্মিক প্রকাশ লক্ষ করি, আমরা বিস্মিত হয়ে যাই তার প্রচণ্ড প্রাণশক্তিতে, তার অশেষ ক্ষমতায়, গভীর আনন্দময় করুণাঘন অভিব্যক্তিতে। এক অবিশ্বাসী পৃথিবীর চোখের সামনে তিনি খোলাখুলি উজাড় করে দিয়েছিলেন আধ্যাত্মিক সত্যের রত্নরাজী। যে সহজাত আধ্যাত্মিক ঐশ্বর্য তিনি প্রকাশ করতেন, তা ছিল বিস্ময়করভাবে বহুলাঙ্গ দ্যুতিময়। যেমন অবিশ্বাসীদের কাছে, তেমনি বিশ্বাসীদের কাছেও তিনি ছিলেন এক কঠিন সমস্যা। তাঁর আধ্যাত্মিক গভীরতায় বৈশিষ্ট্য ছিল এক বিরল প্রাণশক্তি যা আর পাঁচজনের মধ্যে ছড়িয়ে দেবার দুর্দমনীয় আবেগে উদ্দীপ্ত হতেন তিনি। কেবল আত্মার শক্তিতে নির্ভর করেই তিনি চলতেন। যে পরম সত্য তাঁর সত্তার অন্তরশায়ী, তার সঙ্গে নিরবচ্ছিন্ন যোগ থাকায় ঈশ্বরের প্রকৃত অস্তিত্ব ও তাঁর নিকট-সান্নিধ্য সম্পর্কে ছবির মতো বুঝিয়ে দিতে পারতেন মানুষকে। অখণ্ডতা সঙ্গতি পরাদৃষ্টি প্রভৃতি আধ্যাত্মিক জীবনের উচ্চতর সত্যগুলির প্রমাণভিত্তিক যথার্থতার প্রতিপাদনই ছিল সেইযুগের সবচেয়ে বড়ো প্রয়োজন। আত্মবোধের নিশ্চিন্ততায় নিমগ্ন শ্রীরামকৃষ্ণকে শুষ্ক বিচার বিশ্বাসহীনতার মরুভূমিতে মনে হতো একটি সবুজ মরূদ্যান। শ্রীঅরবিন্দ বলেছেন, পাঁচশো বছরে আর একজন রামকৃষ্ণের ভার পৃথিবী ধারণ করতে পারবেন না।
সাধক শ্রীরামকৃষ্ণের আর একটি অসাধারণ বৈশিষ্ট্য হল যে বিজ্ঞানীর মতো মনের গড়ন ছিল বলে তিনি কোনোকিছুই প্রমাণ ছাড়া মেনে নিতে পারতেন না। বিজ্ঞানের পথ ধরেই তাঁর সাধনা এগিয়েছিল। কোনো কিছু মেনে নেবার আগে গভীর পর্যবেক্ষণ, পরীক্ষা, গবেষণা এবং পুঙ্খানুপুঙ্খ বিচারের পর, তবে তিনি কোনো কিছু মেনে নিতে প্রস্তুত ছিলেন। ঠিক সেই কারণেই সংশয়ান্বিত পৃথিবীকে অধ্যাত্মজীবনের বাস্তবতা সম্পর্কে এত স্পষ্ট ও প্রত্যক্ষ পরিচয় দিতে সমর্থ হয়েছিলেন তিনি। মহৎ সত্যগুলিকে আবিষ্কার করার পর পরীক্ষিত সত্যের প্রদর্শনের ক্ষেত্রে তাঁর সত্তা প্রকৃতই একটি বীক্ষণাগারে পরিবর্তিত হয়েছিল। উপনিষদের বাণীর সত্যতার অভ্রান্ত প্রমাণ, রামকৃষ্ণের জীবনালোকে সমস্ত শাস্ত্রবচনই এক নতুন অর্থে প্রভাবিত হলো, নতুন জীবন পেল তাঁরা। তাই স্বামী বিবেকানন্দ বলেছেন—
‘শ্রীরামকৃষ্ণের জীবনের আশ্চর্য সন্ধানী আলোয় সমগ্র হিন্দু ধর্মের যথার্থ পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের সামনে উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে। শাস্ত্রসমূহে যে জ্ঞান তাত্ত্বিক স্তরে সীমাবদ্ধ ছিল, তার ব্যবহারিক রূপ দেখা গেল তাঁর জীবনে। ঋষি ও অবতারগণ যে বিষয়ে শিক্ষা দিতে চেয়েছিলেন, তাঁর জীবন দিয়ে তিনি তাই করলেন। শ্রীরামকৃষ্ণকে না জেনে বেদ, বেদান্ত, ভাগবত এবং অন্যান্য পুরাণসমূহের প্রকৃত অর্থ উপলব্ধি করা কারো পক্ষে কখনোই সম্ভব নয়।’
উপলব্ধিই ধর্মের মূল কথা। যে হৃদয় সত্যকে জানার জন্যে তৃষিত হয়ে আছে, কোনো বিশেষ ধর্মমত কি তাকে তৃপ্তি দিতে পারে? একমাত্র উপলব্ধিজাত দৃঢ় বিশ্বাসই সত্যসন্ধানের প্রক্রিয়ায় টাটকা বাতাসের ছোঁয়া এনে দিতে পারে। পরাদৃষ্টির অধিকারী হওয়া এবং ঈশ্বরের নানা রূপের মধ্যে অখণ্ড সত্তার উপলব্ধিই হলো আধ্যাত্মিক জীবনের লক্ষ্য। স্বামী
তথাগতানন্দের ‘আভাসিত আলো’ থেকে