কুরুক্ষেত্র যুদ্ধস্থলে বহু প্রখ্যাতনামা ব্যক্তি উপস্থিত থাকিলেও গীতায় কেবলমাত্র শ্রীকৃষ্ণ, অর্জ্জুন, সঞ্জয় ও ধৃতরাষ্ট্র এই চারিটি চরিত্রেরই কর্ম্মতৎপরতা দৃষ্ট হয়। এই চারিটি চরিত্র মানব-সমাজের চিরন্তন চারিটি ব্যক্তিত্বের পরিচয় প্রদান করিতেছে। ইঁহারা প্রত্যেকেই নিজস্ব চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য লইয়া প্রস্ফুটিত হইয়াছেন। শ্রীকৃষ্ণ হইলেন মানবসমাজে আদর্শ আচার্য্যের প্রতীক। যিনি বিষয় ভোগের মধ্যে থাকিয়াও মানব মনকে নিস্পৃহ করিয়া তুলিতে পারেন। সকল কর্ম্মের মধ্যে থাকিয়াও যিনি মনকে নৈষ্কর্ম্মাবস্থায় উন্নীত করিতে পারেন। সকল বাস্তবতার মধ্যেও যিনি সকল হৃদয়ে অপ্রাকৃত অতীন্দ্রিয়কে ফুটাইয়া দিতে পারেন—যিনি আধ্যাত্মিকতার চরম শিখরে এবং যোগকর্ম্মের সুকৌশল অবস্থায় যাঁহার অশেষ অধিকার। এইরূপ শক্তিমান আচার্য্যই সামগ্রিকভাবে সমস্ত জীবনকে আধ্যাত্মিক সাধনায় সিদ্ধ করিয়া অবহেলায় মুক্তির সন্ধান দিতে পারেন। এইরূপ আচার্য্য জগতকে আধ্যাত্মিকতা শিক্ষা দিবেন সখ্যভাবে। শ্রীকৃষ্ণ ও অর্জ্জুন-চরিত্রে ইহাই পরিস্ফুট হইয়াছে। আজকাল সমাজে আচার্য্যগণ কর্ত্তৃক যেভাবে আধ্যাত্মিকতা শিষ্যদিগকে শিক্ষা দিবার রীতি প্রচলিত আছে তাহাতে শিষ্যদের শিক্ষা করিবার মত সুযোগই বিরল। তদুপরি অন্তরঙ্গ ও বহিরঙ্গ এই দুইটি কথা বলিয়া একই আচার্য্যের শিষ্যদের মধ্যেও একটা বিভেদের গণ্ডী সৃষ্টি করা হইয়াছে। গীতা এ সকল কথা কিছুই স্বীকার করেন না। গীতার সাধনাই অন্তরঙ্গ সাধনা। ‘অন্তর’ শব্দ গম্ ধাতুযোগে বা ‘অন্তর’ সহিত ‘অঙ্গ’ শব্দযোগে ‘অন্তরঙ্গ’ শব্দের উৎপত্তি। তাহা হইলে ‘অন্তরঙ্গ’ শব্দের অর্থ দাঁড়ায় অন্তরে যিনি গমন করিয়াছেন বা অন্তর অঙ্গে যিনি সাধনায় ব্যাপৃত তিনি অন্তরঙ্গ সাধক। গীতায় উক্ত রাজযৌগিক সাধনা নির্ব্বেদ বা বেধী অনুষ্ঠানরহিত বিধায় কেবলমাত্র অন্তরঙ্গ ধারায়ই উহা নিষ্পন্ন হয়। তাই কোন কোন শিষ্যের সহিত আচার্য্যের বিশেষ বান্ধবতার কোন প্রশ্ন এখানে নাই। অর্জ্জুন হইলেন যথাযথ তত্ত্বজিজ্ঞাসুর প্রতীক। শ্রীকৃষ্ণের ন্যায় আচার্য্যের নিকট অর্জ্জুনের ন্যায় তত্ত্বজিজ্ঞাসু যে নিঃসন্দেহে ব্রহ্মপদাধিকারী হইতে পারেন, গীতা তাহারই প্রমাণ। সঞ্জয় হইলেন সমগ্র গীতার যোগবাণীর জাগ্রত রূপ। আত্মদর্শী মহাপুরুষ। ধৃতরাষ্ট্র হইলেন সমগ্র জগতের বিষয়ীমনের প্রতিচ্ছবি—যিনি ভিতরে ও বাহিরে সকল দিকেই অন্ধ।
গীতার দর্শন বহু ভাবে রূপকের মাধ্যমে প্রকাশিত হইয়াছে। কিন্তু অনেকে তত্ত্বের দিক্ দিয়া গীতার মূল উপাখ্যানভাগের চরিত্রগুলিকেও রূপকভাবে ব্যাখ্যা দিয়া থাকেন। গীতার তত্ত্ব যুগ যুগ ধরিয়া বহু সাধকের নিকট বহুভাবে উদ্ভাসিত হইয়াছে, হইতেছে এবং হইবেও। তাঁহারা প্রত্যেকে তত্ত্ববেত্তা ইহাতে সন্দেহ নাই। যুক্তিবাদ ও বৈজ্ঞানিক ধারাকে অক্ষুণ্ণ রাখিয়া গীতার পারস্পরিক শ্লোক, আদর্শ ও নীতি এবং সর্ব্বজাতির সর্ব্বকালের প্রচারিত দর্শনের সত্য সঙ্গতি রক্ষা করিয়া যাঁহাদের উপলব্ধ তত্ত্ব আত্মপ্রকাশ করিয়াছে, তাহা অস্বীকার করা যায় না। কেহ কেহ উপাখ্যানভাগের রূপক ভাষ্য দিতে যাইয়া দেহকেই বলিয়াছেন কুরুক্ষেত্র। দশ ইন্দ্রিয় ও তাহাদের প্রত্যেকের দশদিকজয়ী শক্তি (১০×১০= ১০০), ইহারা একশত কুরুপুত্র। পঞ্চ পাণ্ডব হইল দেহস্থ পঞ্চ তত্ত্ব (শব্দ, স্পর্শ, রূপ, রস ও গন্ধ)। দেহস্থ ইন্দ্রিয়াদি (ধৃতরাষ্ট্র-পুত্রগণ) যুদ্ধার্থ পঞ্চতত্ত্বের (পঞ্চ পাণ্ডবের) বিরুদ্ধে দণ্ডায়মান। দেহস্থ কুটস্থ চৈতন্যসত্তা আত্মজ্ঞানরূপ শ্রীকৃষ্ণ। অন্ধ বিষয়ীমন ধৃতরাষ্ট্র বিবেকবুদ্ধিরূপী দিব্যদ্রষ্টা সঞ্জয়কে সকল জিজ্ঞাসা করিয়া জ্ঞাত হইতেছেন।
শ্রীকৃষ্ণের দ্বিবিধভাবে গীতার সৃষ্টি
‘‘গীতার সর্ব্বজনীন চিরকালের বাণী জাগ্রত হইয়া উঠিয়াছিল শ্রীকৃষ্ণের অসঙ্গ মনে—কুরুক্ষেত্র যুদ্ধস্থলের এক নিরপেক্ষ ভূমিতে। নির্ব্বেদ সাধনার কথা জানাইলেন তিনি অর্জ্জুন তথা জগতকে দেহ ও দেহাতীত এই দুটি বোধের উপর প্রতিষ্ঠিত হইয়া।
মহর্ষি প্রেমানন্দের ‘‘গীতায় ভগবান’’ থেকে