কর্মে শুভ। নতুন কর্মপ্রাপ্তি বা কর্মসূত্রে দূররাজ্য বা বিদেশ গমন হতে পারে। আনন্দানুষ্ঠানে যোগদান ও ... বিশদ
তৎপদং দশিতং যেন তস্মৈ শ্রীগুরবে নমঃ।।’’
এই শ্লোকটি শ্রীগুরুর নমস্কার শ্লোক। লক্ষ্য করিতে হইবে এই স্থলে গুরুকে শ্রীগুরু বলিয়া উল্লেখ করা হইয়াছে। শ্রীশব্দ পরাশক্তির বাচক, সুতরাং শ্রীসহিত বা শ্রীযুক্ত গুরুই শ্রীগুরু ইহাতে কোন সন্দেহ নাই। গুরু শক্তিহীন শিব হইলে তাঁহাদ্বারা জীব বা জগতের কল্যাণসাধন সম্ভবপর হয় না। বস্তুতঃ তিনি জীবের উপাস্য নন, এমন কি নমস্কারের বিষয়ীভূত নন। কারণ শক্তিহীন শিব অব্যক্ত ও জীবের পক্ষে অনধিগম্য। হঠযোগ এবং তন্ত্রশাস্ত্র উভয়স্থলেই স্বরূপভূতা শক্তির সঙ্গে নিত্যমিলিত গুরুকে লক্ষ্য করিয়া শাস্ত্ররহস্য বর্ণিত হইয়াছে। কুণ্ডলিনীশক্তি জাগ্রত হইয়া যাবতীয় আধারকমল বিদ্ধ এবং অতিক্রম করিতে করিতে উত্থিত হইয়া সহস্রদলের বিন্দুস্থানে পরমশিবের সহিত মিলিত হন। এই মিলন নিত্য মিলন। এই মিলনে শিবরূপী গুরু শক্তিযুক্তরূপে সাক্ষী জীবের নিকট নিরন্তর অপরোক্ষভাবে প্রকাশিত হন। জীব সাধনবলে অথবা ভগবৎকৃপায় কোন শুভ মুহূর্তে এই মহা মিলনের অবস্থা লাভ করে। কিন্তু শ্রীগুরু নিত্যই নিজশক্তি দ্বারা আলিঙ্গিত থাকেন। তাই তিনি নমস্য।
‘তস্মৈ শ্রীগুরবে নমঃ’ বলিতে এই চৈতন্যরূপা শক্তিসংযুক্ত পরম গুরুতত্ত্বই জীবের নমস্কারের বিষয়রূপে লক্ষিত হইয়াছে। নমঃ বলিতে বুঝায় ন মম অর্থাৎ আমার নয় অর্থাৎ তোমার বা তাঁহার। আমি ভাব এবং তন্মূলক মমত্বভাব যাঁহাকে অর্পণ করা যায় তাহাই আমির পক্ষে নমস্য। এই নমস্কার শ্লোকে শ্রীগুরুতে আত্মসমর্পনের কথা বলা হইয়াছে। শুধু গুরুমাত্রে নহে।
শ্রীগুরুর স্বরূপটি বুঝাইবার জন্য শ্লোকের পূর্বাংশ উপদিষ্ট হইয়াছে। এই স্থানে পরমতত্ত্ব উপেয়রূপে এবং উপায়রূপে দুইভাবেই স্পষ্টভাবে নির্দিষ্ট হইয়াছে। যিনি উপেয় তাঁহাকে পরমপদ বলিয়া অর্থাৎ বিষ্ণুর পরমপদ বলিয়া গ্রহণ করা যাইতে পারে। ইহা ভগবদ্ভাবেরও অতীত পরমাবস্থা। যিনি এই পরমপদকে জীবের নিকট প্রকাশিত করেন তিনিই গুরু। বস্তুতঃ উপেয়রূপ পরমপদ এবং উপায়রূপ গুরু মূলতঃ অভিন্ন। কারণ উভয়ে স্বরূপগত ভেদ থাকিলে একটির দ্বারা অপরটির প্রাপ্তি বা প্রকাশন সম্ভবপর হইত না। যে যাহা নয় সে তাহা জানে না এবং জানাইতেও পারে না। সুতরাং যিনি পরমপদ স্বরূপ তিনিই যে বস্তুতঃ গুরুতত্ত্ব তাহাতে কোনই সন্দেহ নাই। তিনি স্বপ্রকাশ বলিয়া নিজেকে নিজে সদাই জানেন এবং পরপ্রকাশক বলিয়া নিজেকে জগতের নিকট প্রকাশ করেন। এই যে প্রকাশক রূপ ইহাই গুরুর রূপ। এই যে স্বপ্রকাশরূপ ইহাই পরমপদের স্বরূপ। বস্তুতঃ জীব বা জগতের নিকট সেই পরমবস্তুর প্রকাশ হইতেই পারে না। সুতরাং বুঝিতে হইবে গুরু যখন স্বীয় স্বরূপকে অর্থাৎ পরমতত্ত্বকে পরের নিকট প্রকাশিত করেন তখন পরকে আপন করিয়াই তাহা করেন নতুবা তাহা সম্ভবপর হইত না। এইজন্য যতক্ষণ জীবের তৃতীয় নেত্র অথবা জ্ঞান নেত্র উন্মিষিত না হয়—ততক্ষণ পরমপদ স্বপ্রকাশ হইলেও তাহার নিকট প্রকাশিত হয় না। শ্রীগুরুই এই জ্ঞাননেত্র—উন্মেষের কারণ। অনাদি অজ্ঞান পাশে আবদ্ধ জীব যতক্ষণ শ্রীগুরুর কৃপায় এই জ্ঞাননেত্রের উন্মীলনের. সৌভাগ্য লাভ না করে ততক্ষণ তাহার পক্ষে মিথ্যাদর্শন ব্যতিরেকে পরমার্থ দর্শনের সম্ভাবনা কোথায়?
ডক্টর গোপীনাথ কবিরাজের ‘পত্রাবলী’ থেকে