যারা বিদ্যার্থী তাদের মানসিক অস্থিরতা বৃদ্ধি পাবে। নানা বিষয়ে খুঁতখুঁতে ভাব জাগবে। গোপন প্রেম থাকলে ... বিশদ
কৃষ্ণপ্রেমের স্নিগ্ধ সাত্ত্বিক ভাবকে দুটি ভাগে ভাগ করা হয়েছে— প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ। রাধারাণী এক সময় কুন্দ ফুলের একটি মালা গাঁথছিলেন, তখন শ্রীকৃষ্ণের বংশীধ্বনি শুনে তিনি তৎক্ষণাৎ মালা গাঁথা বন্ধ করে দেন। এটি হচ্ছে প্রত্যক্ষ স্নিগ্ধ সাত্ত্বিক ভাবের একটি উদাহরণ। পরোক্ষ স্নিগ্ধ সাত্ত্বিক ভাবের বর্ণনা নিম্নলিখিত উদ্ধৃতিতে পাওয়া যায়, ‘‘চাতক পক্ষীর চোখে বর্ষার জলভরা মেঘ যেমন, মা যশোদার চক্ষে পুরুষোত্তম শ্রীকৃষ্ণও তেমন। শ্রীকৃষ্ণকে যখন মথুরায় নিয়ে যাওয়া হয়, তখন অত্যন্ত উৎকণ্ঠিত ও ক্রুদ্ধ হয়ে মা যশোদা মথুরার রাজাকে তিরস্কার করতে থাকেন।’’
দিগ্ধ সাত্ত্বিক ভাবকে তিনটি ভাগে ভাগ করা হয়েছে, তার একটি দৃষ্টান্ত হচ্ছে—একদিন মা যশোদা স্বপ্নে দেখলেন যে, পূতনার বিশাল শরীর তাঁর গৃহের প্রাঙ্গণে পড়ে রয়েছে, তা দেখে তিনি অত্যন্ত উৎকণ্ঠিত হয়ে শ্রীকৃষ্ণকে খুঁজতে শুরু করলেন।
ভাবের লক্ষণ যখন অভক্তের শরীরে প্রকাশিত হতে দেখা যায়, তখন তাদের বলা হয় রুক্ষ লক্ষণ। অভক্ত সাধারণত বিষয়ী, কিন্তু কোন শুদ্ধ ভক্তের সংস্পর্শে আসার ফলে তাদের মধ্যে কখনও কখনও দিব্যভাব প্রকাশিত হতে দেখা যায়। ভক্তিতত্ত্ব বিশারদেরা সেই লক্ষণকে রুক্ষ সাত্ত্বিক ভাব বলে বর্ণনা করেন। সাত্ত্বিক ভাবের আটটি লক্ষণ রয়েছে—স্তম্ভ, স্বেদ, রোমাঞ্চ, স্বরভেদ, কম্পন, বিবর্ণতা, অশ্রুধারা ও প্রলয়।
শ্রীল রূপ গোস্বামী এই সমস্ত ভাবের বিজ্ঞানসম্মত বিবরণ দিয়েছেন। প্রাণশক্তি যখন পৃথিবীতে স্থির হয়, তখন স্তম্ভের উৎপত্তি হয়। সেই শক্তি যখন জলের সংস্পর্শে আসে, তখন অশ্রুধারা ঝরে পড়ে। সেই শক্তি যখন অগ্নির সংস্পর্শে আসে, তখন স্বেদ ও বৈবর্ণ দেখা দেয়। তা যখন আকাশের সংস্পর্শে আসে, তখন মূর্ছা উৎপন্ন হয়। আর সেই শক্তি যখন বায়ুর সংস্পর্শে আসে, তখন কম্প, স্বরভেদ এবং শরীরে রোমাঞ্চ দেখা দেয়।
এই সাত্ত্বিক ভাব কখনও বাহ্যরূপে এবং কখনও আভ্যন্তরীণরূপে প্রকাশিত হয়। শুদ্ধ ভক্ত এই সমস্ত ভাবগুলি নিরন্তর হৃদয়ে অনুভব করেন কিন্তু বহির্মুখ মানুষদের ভয়ে তাঁরা সাধারণত সেগুলি বাহ্যিকভাবে প্রকাশ করেন না।
স্তম্ভ
স্তম্ভের উৎপত্তি হর্ষ, ভয়, বিস্ময়, শোক ও ক্রোধ থেকে হয়। প্রাণীর স্তব্ধতা, নিশ্চলতা, শূন্যতা ও গভীর বিরহের অনুভূতি এই ভাবের লক্ষণ।
উদ্ধব যখন বিদুরের কাছে শ্রীকৃষ্ণের লীলা বর্ণনা করছিলেন, তখন তিনি বলেন, ‘‘একদিন শ্রীকৃষ্ণ এক মালিণীর রূপ ধারণ করে উদ্যানে প্রবেশ করে, হাস্য-পরিহাসের দ্বারা গোপিকাদের আনন্দিত করেন। গোপিকারা তখন স্তম্ভিত হয়ে যান। তারপর শ্রীকৃষ্ণ যখন সেই উদ্যান পরিত্যাগ করে চলে যান, তখন তাঁরা এমনভাবে শ্রীকৃষ্ণকে দেখছিলেন, যেন তাঁদের চিত্ত ও দৃষ্টি উভয়ই তাঁর অনুগমন করছিল। এই লক্ষণগুলি থেকে বোঝা যায় যে, তাঁদের কার্য সমাপন না হলেও কৃষ্ণপ্রেমে তাঁরা স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিলেন।
স্তম্ভিত হওয়ার আরও একটি উদাহরণ হচ্ছে, শ্রীকৃষ্ণ যখন কংসের রঙ্গমঞ্চে মল্ল-পরিবৃত হয়েছিলেন, তখন তাঁর মা দেবকী স্তম্ভিত হয়ে যান এবং তাঁর নেত্রদ্বয় শুষ্ক হয়ে যায়। স্তম্ভিত হওয়ার আর একটি দৃষ্টান্ত দেখা যায় শ্রীমদ্ভাগবতের দশম স্কন্ধে। ব্রহ্মা যখন বুঝতে পারেন যে, এই গোপ শিশুটি হচ্ছেন স্বয়ং পরমেশ্বর ভগবান, তখন তিনি স্তম্ভিত হয়ে যান। শ্রীকৃষ্ণের সঙ্গে সমস্ত গোপবালকদের দর্শন করে তাঁর সমস্ত ইন্দ্রিয়ের কার্যকলাপ স্তব্ধ হয়ে যায়। তখন তাঁকে দেখে মনে হচ্ছিল, যেন চতুর্মুখ-বিশিষ্ট একটি স্বর্ণমূর্তি। ব্রজবাসীরা যখন দেখলেন যে, শ্রীকৃষ্ণ তাঁর বাঁ-হাতে গিরি-গোবর্ধন তুলে ধরেছেন, তখন তাঁরা স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিলেন।
শ্রীল রূপ গোস্বামী বিরচিত ‘ভক্তিরসামৃতসিন্ধু’ থেকে