বাধা ও অসফলতার জন্য চিন্তা। মানসিক টানাপোড়েনের মধ্যে কোনও ভালো যোগাযোগ পেতে পারেন। ... বিশদ
মন হ’ল জড়, মন্ত্র চেতন। বলা হয়ে থাকে, মন্ত্রে অক্ষরবুদ্ধি করতে নেই। আপাতভাবে মন্ত্র একটি অক্ষর, শব্দ বা শব্দসমষ্টি। কিন্তু সেটি হ’ল তাঁর নেহাৎই মৃন্ময়মূর্ত্তি। তাঁর মধ্য দিয়ে যে দ্যোতনা ও ব্যঞ্জনার উদ্ভব ঘটে, তাঁর যে উদ্ধারণের সার্মথ্য, তাই হ’ল মন্ত্রের আসল মূর্ত্তি— যা পুরোপুরি চিন্ময়, চেতনাশ্রয়, চৈতন্যময়। সেই শক্তিই আমাদের উপর অতি ধীরে ধীরে জপের মধ্য দিয়ে মনপ্রাণকে উত্তরণে সাহায্য করে। অতি সুদীর্ঘ অপসংস্কারের প্রকোপে আমাদের মন-প্রাণ মলিন ও ক্লিন্ন। শিশিরের বিন্দু বিন্দু ফোঁটার মতন জপ ব্যক্তির দেহ, মন, প্রাণের উপর ক্রিয়া করে।
মনের গতিপ্রকৃতি অতি বিচিত্র। চিদাকাশের বুকে মন যেন থরে থরে সাজানো মেঘের সারি। এই সে উৎফুল্ল এই যে বিমর্ষ, এই সে তুষ্ট, এই সে রুষ্ট, এই উজ্জীবিত এই ক্লান্ত, এই অনুকূল পরমুহূর্ত্তে প্রতিকূল। নিরন্তর নানাবিধ টানাপোড়েন সংঘর্ষ ও দ্বিধাদ্বন্দ্বের মধ্যেই এর বিচরণ—অতি ক্ষিপ্র গতিতে। মুহূর্ত্তে মুহূর্ত্তে সে রং পাল্টায়, ভোল বদলায়—অস্থিরচিত্ত চপলমতি বালকের মতন। শিশু না-হয় বড় হয়ে ঠিক হয়, কিন্তু মন শতবর্ষেও বৃদ্ধ হয় না। আমাদের ভিতরে থেকে সে নেহাৎই ছেলেমানুষি ক’রে চলে, তা আমরা যত দায়িত্বশীল পদে অধিষ্ঠিত অথবা যত বয়োবৃদ্ধ হই না কেন। এই মনকে ত্রাণ না করলে এ আমাদের ভুগিয়ে ও জ্বালিয়ে মারবেই মারবে।
মন যতক্ষণ সুনিয়ন্ত্রিত না হচ্ছে ততক্ষণ কর্ম্মশক্তি, সাধনশক্তি, ইচ্ছাশক্তির স্ফুরণ ঘটে না। মনের আধারেই এদের বাস। তাই মনকে সুনিয়ন্ত্রিত করা এত জরুরী। মূল প্রশ্ন হল, আমার অধীন, না আমি মনের অধীন? দেহ এবং পরিবেশ আবার মূলত সেই মনের অধীন। সুতরাং সেই মনকে যদি আমার অধীন না রাখতে পারি, তবে দেহ পরিবেশ ইত্যাদি কিছুই আমার অধীনে থাকে না; ঝড়ের মুখে শালপাতার মতন আমাকে ব্রহ্মাণ্ডময় আছাড় খেয়ে মরতে হয়। জপ সুরু করা মানে, এই সমুদ্র-ঝঞ্ঝার মধ্যে নোঙ্গর করার প্রয়াস, মহাসমুদ্রে খাবি খাওয়া থেকে পরিত্রাণের প্রথম পদক্ষেপ। জপ সুরু করার প্রথম পর্য্যায়ে মন বানরের মতন ঠেলে ঠেলে আমাদের আসন থেকে উঠিয়ে দিতে চেষ্টা করে। সে সময় ঘাপ্টি মেরে বসে থাকতে হয়। কিছুক্ষণ চেষ্টা করার পর বেটা সাময়িকভাবে রণে ভঙ্গ দেয়। জপসাধনের প্রথম অবস্থায় এরকম কতকিছু ঘটে।
পাগলের একটি বড় লক্ষণ হল, যে ওষুধে আরোগ্য হয়, পাগল সেটি সযত্নে পরিহার করতে সবিশেষ উদ্যোগী। অন্য সব ব্যাপারে সে পাগল, কিন্তু এই ব্যাপারে তার টনটনে জ্ঞান। আত্মীয়স্বজনদের তাই তাকে ওষুধ খাওয়াতে কত ঝামেলা, কত কৌশল, কত যন্ত্রণা! আমরা যে জপ সুরু করি না, জপে বসি না বা জপে লেগে থাকি না—তা মূলত এই কারণেই। মন্ত্রজপে মনের তাই প্রাথমিক পর্য্যায়ে বিষম বিতৃষ্ণা ও বিরোধীতা।
নিজের মনের সঙ্গে নিজের লড়াই বস্তুত সবচেয়ে কঠিন, কষ্টসাধ্য এবং সুদীর্ঘ সংগ্রাম। জপসাধনাকে তাই সুদীর্ঘ এবং আয়াসসাধ্য হতেই হয়। সহস্র সহস্র বৎসরের অপসংস্কৃত মন দু’এক বছরের ক্ষীণ প্রয়াসে সম্পূর্ণ নিরাময় হয়ে যাবে—প্রায়ই তা হয় না, যদি-না মহতের বিশেষ কৃপা বা শক্তিপাত ঘটে। আর সে দুর্লভ সুযোগ ঘটলেও মুস্কিল এই—আমার মন যে তার মূল্য দিতে পারে না, জানে না। সে নিজে যতক্ষণ-না প্রয়াস পাচ্ছে, ততক্ষণ সে মুক্ত হতে পারে না। বস্তুত তাকে নিজেকেই নিজে উদ্ধার করতে হয়— ‘উদ্ধরেদাত্মনাত্মানম্’। মন্ত্র-জপ মানে মনের নিজ উদ্ধার-প্রয়াসে মনকে সাহায্য করা। অপসংস্কারের অতি পুরু আস্তরণ আমাদের মনের চারপাশে জমে উঠেছে। সেটিকে দূর করতে হলে জপরুপী সদভ্যাস নিয়মিতভাবে সুদীর্ঘকাল চালানো প্রয়োজন।
অযাচকের ‘জপ’ থেকে