নোট বাতিল ঘোষণার কয়েক মাসের মধ্যেই কেলেঙ্কারির অভিযোগে কাঠগড়ায় ওঠে মোদি সরকার। ২০১৬ সালের ৮ নভেম্বরের হেমন্ত সন্ধ্যায় নোটবন্দির কথা ঘোষণা করেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। ঠিক তার পরের বছরের জানুয়ারি মাসেই নতুন ৫০০ ও ২০০০ টাকার নোট দু’রকম ছাপা হচ্ছে বলে সংসদে অভিযোগ করে বিরোধীরা। দু’টি ক্ষেত্রেই বিভিন্ন আয়তন, ভিন্ন নকশা—এমন নোট ছাপা হচ্ছে বলে গুরুতর অভিযোগ ওঠে। শুধু তাই নয়, বিরোধীরা দু’রকম নোটের ছবিও তুলে ধরে সংসদে। চাপের মুখে তৎকালীন অর্থমন্ত্রী এই অভিযোগ স্বীকার করে নেন। তবে তিনি যুক্তি দেন, ছাপাখানার সমস্যায় নোটের আকার ও নকশায় সামান্য এদিক-ওদিক হতে পারে! বিরোধীরা একে কেলেঙ্কারি বলেই অভিযোগ করেছিল, যা কার্যত কেন্দ্র নস্যাৎ করে দেয়। কিন্তু নোটবন্দিকে কেন্দ্র করে নানা রহস্য সেইসময় থেকেই দানা বাঁধতে থাকে। সম্প্রতি সরকারি নোট ছাপাখানার দেওয়া চাঞ্চল্যকর একটি তথ্যকে ঘিরে আরও নানা প্রশ্ন উঠছে। যার সদুত্তর এখনও সরকার দেয়নি। অথচ নোটবন্দির হঠকারী সিদ্ধান্তের ক্ষত এখনও শুকায়নি। দেশের অর্থনীতির উপরও তা মারাত্মক প্রভাব ফেলেছে। ওই সিদ্ধান্তের জেরে ব্যাঙ্কের লাইনে দাঁড়িয়ে যে মানুষগুলি প্রাণ হারিয়েছেন সে ক্ষতিও অপূরণীয়। নোটবন্দির সিদ্ধান্তের সাংবিধানিক বৈধতা নিয়েও সুপ্রিম কোর্টে অজস্র আবেদন জমা পড়ে। আবেদন শোনার জন্য সাংবিধানিক বেঞ্চও গঠিত হয়। এবার আবার সরকারের অস্বস্তি বাড়িয়ে চর্চার ভরকেন্দ্র হিসেবে অন্য একটি চাঞ্চল্যকর তথ্য সামনে এল। মুম্বইয়ের এক প্রবাসী বাঙালির আরটিআই-এর জবাবে নাকি কেন্দ্রীয় ছাপাখানা জানিয়েছে, ২০১৫ সালের এপ্রিল থেকে ২০১৬-র ডিসেম্বর পর্যন্ত—এই দেড় বছরে সাড়ে ৩৭ কোটি নতুন ডিজাইনের ৫০০ টাকার নোট ছাপা হয়েছে। শুধু তাই নয়, নতুন ছাপা নোটে আরবিআই গভর্নর হিসেবে উর্জিত প্যাটেলের সই রয়েছে, যিনি দায়িত্ব নিয়েছেন ২০১৬-র সেপ্টেম্বরে। এক্ষেত্রে দুটি প্রশ্ন উঠছে। নোট বাতিলের দেড় বছর আগে থেকে যদি নোট ছাপা শুরু হয়ে থাকে তাহলে কি ধরে নেওয়া হবে অত্যন্ত পরিকল্পনা মাফিক আটঘাট বেঁধেই এগচ্ছিল মোদি সরকার? নোটবন্দির ঘোষণা হয়েছে ’১৬-র ৮ নভেম্বর। তাহলে তার এত আগে কীভাবে নতুন ৫০০ টাকার নোট ছাপা শুরু হল? এর থেকেও বড় জিজ্ঞাসা হল, রিজার্ভ ব্যাঙ্কের গভর্নর হওয়ার আগেই কীভাবে নতুন ডিজাইনের ৫০০ টাকার নোটে চলে এল উর্জিত প্যাটেলের সই? এইসব অভিযোগ তুলে আরটিআই অ্যাক্টিভিস্ট মনোরঞ্জন রায় সুপ্রিম কোর্টে মামলায় যুক্ত হতে চেয়ে প্রধান বিচারপতিকে চিঠি দিয়েছেন বলে জানিয়েছেন। আদালতে মোদি সরকারের দেওয়া ১৬ পাতার জবাবের সঙ্গে আরটিআই-এর তথ্যের ফারাক প্রকাশ্য হয়েছে। বিষয়টি মহামান্য আদালতে বিচারাধীন। যদিও নোটবন্দির বিষয়টি এখনও দেশবাসীর সামনে রহস্যাবৃতই রয়েছে। জনমনে উদয় হওয়া কোনও প্রশ্নের উত্তরই মেলেনি।
আসলে নোটবন্দির কোনও সুফলই পায়নি দেশবাসী। ঘোষণা ছিল, কালো টাকা ফিরবে দেশে। দুর্নীতির কারবারে লাগাম পড়বে। এই দুটি বড় প্রশ্নেই মোদি সরকার ডাহা ফেল করেছে। নোটবন্দি এখন নিছক পাঠ্য বিষয়ে উপনীত হয়েছে এবং আর তা প্রাসঙ্গিক নয় বলে গেরুয়াবাহিনী দাবিও করছে! অথচ মানুষ এখনও হাড়েহাড়ে নোটবন্দির জ্বালা টের পাচ্ছে। প্রায়শই দেশের বিভিন্ন প্রান্তে কোটি কোটি কালো টাকা উদ্ধারের খবর মিলছে! দেশে জালনোটের পরিমাণও বেড়েছে। সংসদে সরকার আগেই জানিয়েছিল বাতিল হওয়া ৫০০ ও ১০০০ টাকার নোটের মূল্য ১৫.৪৪ লক্ষ কোটি টাকা। ব্যাঙ্কের হাতে এর মধ্যে ফেরত এসেছে ১৫.৩১ লক্ষ কোটি টাকা। অর্থাৎ ৯৯.৩ শতাংশ। তাহলে কালো টাকা গেল কোথায়? সরকার পক্ষ নোটবন্দির সময়ে উদ্ধার হওয়া যে পরিমাণ কালো টাকার দাবি করেছিল তাতেও রিজার্ভ ব্যাঙ্ক জল ঢেলে দিয়েছে। নোটবন্দির সুফল দেখাতে গিয়ে সরকার ডিজিটাল লেনদেনে গুরুত্ব দিয়েছিল। কিন্তু দেখা গিয়েছে, নোটবন্দির অব্যবহিত আগে দেশের মানুষের হাতে যে পরিমাণ নগদ টাকা ছিল, ছ’বছরে তা বেড়েছে ৭১.৮৪ শতাংশ। অর্থাৎ মোদির চটকদারি ওই ঘোষণার কোনও সুফলই ভোগ করেনি দেশবাসী। স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠেছে, নোট বাতিল করে কি তবে কালো টাকা সাদা করারই প্রকল্প নিয়েছিল সরকার?
নোট বাতিল প্রসঙ্গে মামলার এখন আর তেমন গুরুত্ব নেই বলে কেন্দ্র দাবি করছে। বেশ বোঝা যাচ্ছে সরকার স্বস্তিতে নেই। কখনও রিজার্ভ ব্যাঙ্ক, কখনও-বা আরটিআই-এর মাধ্যমে একের পর এক যে সব তথ্য সামনে আসছে তা সরকারকে বেকায়দায় ফেলছে। দুর্নীতিমুক্ত ভারতের স্বপ্ন দেখিয়ে যিনি কুর্সিতে বসেছেন তাঁর জমানাতেই এটা আরও বড় ধরনের কোনও দুর্নীতি বা কেলেঙ্কারি কি না সে সংশয় আছে। আদালতের প্রতি দেশবাসীর রয়েছে পূর্ণ আস্থা। কিন্তু সরকারেরও উচিত বিভ্রান্তি কাটাতে আমজনতা বা বিরোধীদের মনে উদয় হওয়া যাবতীয় প্রশ্নের উত্তর দেওয়া।