মাথা নিচু করে বলব ভুল করেছি। এই অকপট স্বীকারোক্তি বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের। তিনি পশ্চিমবঙ্গের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী, মহাকরণে জ্যোতি বসুর উত্তরসূরি। ২০১৫ সালে সিপিএমের রাজ্য সম্মেলনের মঞ্চ থেকে তাঁর এই দ্বিধাহীন কণ্ঠ শোনা গিয়েছিল, সিঙ্গুর ও নন্দীগ্রাম প্রসঙ্গে। শিল্পায়নে ব্যর্থতার দায় যদিও তারও আগে তিনি স্বীকার করেছেন। কিন্তু এতটা সোজাসুজি সেই প্রথম। এমনকী, বাম জমানায় শিক্ষাক্ষেত্রে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপটাও অবাঞ্ছিত ছিল বলে বিরক্তি প্রকাশ করেন বুদ্ধদেববাবু। ১৯৯৯ সালে জ্যোতি বসুর মুখ্যমন্ত্রিত্বের শেষলগ্নে উপমুখ্যমন্ত্রী হন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। ইতিমধ্যে অতি প্রবীণ জ্যোতি বসু শারীরিকভাবে আরও অক্ষম হয়ে পড়েন। ২০০০ সালের ৬ নভেম্বর মুখ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব দেওয়া হয় বুদ্ধদেববাবুকেই। ২০০১ সালের ভোটে জিতে ফের গদিয়ান হয় বামফ্রন্ট এবং মুখ্যমন্ত্রী হন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। জ্যোতিবাবুর দীর্ঘ শাসনকাল নিয়ে সবচেয়ে বড় সমালোচনার ছিল, বাংলার শিল্প-বাণিজ্য ধ্বংস হয়ে গিয়েছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলি হয়ে উঠেছে ক্ষতিকর রাজনীতির আখড়া। তার ফলে বেকারত্বের চরমসীমায় পৌঁছে গিয়েছে বাংলা। দিকে দিকে ধ্বনিত হচ্ছে শাসকের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী কণ্ঠ। স্বভাবতই ক্রুদ্ধ শাসক হাতে তুলে নিয়েছে বিদেশি শাসকের ফেলে যাওয়া দমনপীড়নের নীতি। সিপিএম পার্টি ভেবেছিল বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের সংবেদনশীল মুখটি সামনে রেখে পরিস্থিতি দ্রুত সামলে নেবে। ২০০৬ সালে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য ফের ক্ষমতায় ফিরলেন বামফ্রন্টের নেতা হিসেবেই। কিন্তু সেবার ভোটে জালিয়াতি এবং হিংসা-প্রতিহিংসার অভিযোগ অতীতের সমস্ত রেকর্ড ছাপিয়ে যায়। যে জনরোষ এতদিন তুষের আগুনের মতো ভিতরে ধিকি ধিকি জ্বলছিল, সেটারই বহিঃপ্রকাশ হতে লাগল দিকে দিকে। রাজ্যবাসীকে স্তোক দিতে বামফ্রন্ট স্লোগান তুলল, ‘কৃষি আমাদের ভিত্তি, শিল্প আমাদের ভবিষ্যৎ’। এই আওয়াজ তুলে বামেরা বোঝাতে চাইলেন, ভূমিসংস্কারের মাধ্যমে বাংলায় কৃষির প্রভূত উন্নতি হয়েছে। সেই মজবুত ভিত্তিভূমির উপরেই এবার তাঁরা যুগোপযোগী শিল্প নির্মাণের দৃষ্টান্ত স্থাপন করবেন। 
কিন্তু, শিল্পায়নের নামে বছর বছর নিষ্ফলা বিদেশভ্রমণের যে রেকর্ড জ্যোতি বসু গড়ে গিয়েছেন, সত্যি কথা বলতে কী, তারপর শিল্প নিয়ে এই সরকারের নতুন কোনও অঙ্গীকার বিশ্বাসযোগ্য হয়নি। মানুষ আরও খেপে গেল বুদ্ধদেববাবু যখন শিল্পের জন্য উর্বর কৃষিজমি কেড়ে নেওয়ার জেদ ধরলেন। প্রতিবাদী কৃষক শ্রেণি নানাদিকে মার খাচ্ছিল নির্বিচারে। একটা সময় নিরুপায় মানুষগুলির পাশে গিয়ে ঢাল হয়ে দাঁড়ালেন তৎকালীন বিরোধী নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। মমতার রাজনীতির ধরন সিপিএমের নেতা ও কর্মীদের অজানা নয়। তাঁরা জানতেন, অত্যন্ত নির্ভীক এই মানুষটির আন্দোলনের মধ্যে কোনও খাদ নেই। তিনি যা বলেন, সবটাই অন্তর থেকে এবং তা কাজেও করে দেখান। প্রমাণ রাখলেন ২০০৬-০৭ সালে সিঙ্গুর এবং ২০০৭ সালে নন্দীগ্রাম আন্দোলনে। নন্দীগ্রামের আন্দোলন স্তব্ধ করতে ২০০৭ সালের ১৪ মার্চ চালানো হয়েছিল গণহত্যা (নিহত ১৪ জন)। কিন্তু তাতেও মানুষের প্রতিবাদ থামেনি। দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে ভীত প্রশাসনের পক্ষে যা স্বাভাবিক সেটাই হতে থাকল রাজ্যজুড়ে। সামনে পুলিসের রক্তচক্ষু, চোরাগোপ্তা সেজেগুজে তৈরি ছিল পার্টিরও হার্মাদ বাহিনী। মানুষ মারার জন্য বিরাট বিরাট বেআইনি অস্ত্রভাণ্ডার গড়েছিল তারা। ২০১১ সালের ৭ জানুয়ারি পশ্চিম মেদিনীপুরে লালগড়ের নেতাই গ্রামে গণহত্যার (নিহত ৯ জন) ঘটনায় স্তম্ভিত হয়ে যায় দেশ। জড়িয়ে যায় বুদ্ধদেব মন্ত্রিসভার এক দাপুটে মন্ত্রী ও সিপিএম নেতার নাম। জঙ্গলমহল এক আতঙ্কপুরী হয়ে উঠেছিল। প্রায় দিন এক বা একাধিক ‘লাশ পড়ার’ খবরে ভারী উঠত বাতাস। 
৩৪ বছরের বামশাহি এতটাই অসহনীয় হয়ে উঠেছিল যে, সেবার ভয় সিঁটিয়ে গিয়েছিল সিপিএমের বিশ্বস্ত ভোটশিল্পীরাও। ২০১১ সালের এপ্রিল-মে মাসে বিপুল ভোটে জয়ী হলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। নতুন মুখ্যমন্ত্রীর সার্বিক উন্নয়নের নীতিতে দ্রুত শান্ত হয়ে এল জঙ্গলমহল। এই সরকারের ১১ বছরের শাসনে জঙ্গলমহল এক অচেনা নিসর্গ হয়ে উঠেছে। এখন সেখানে নারী-পুরুষ, আদিবাসী নির্বিশেষে সকলে নির্ভয়ে চাষবাস, ব্যবসা, ভ্রমণ করতে পারছেন। আর সেই সূত্রে বেরিয়ে আসছে বাম জমানার অনেক গোপন কারবার, পাপ। যেমন বুধবার গোয়ালতোড়ের বড়ডাঙা গ্রামে আবিষ্কৃত হয়েছে এক বিরাট পরিত্যক্ত বেআইনি অস্ত্রভাণ্ডার! বছর দুই আগে গোয়ালতোড়েরই উখলা লাগোয়া জঙ্গল থেকে পাওয়া গিয়েছিল প্রচুর বেআইনি অস্ত্রশস্ত্র। এনিয়ে রাজ্যের শাসক দল এবং প্রাক্তন শাসক দলের মধ্যে চাপানউতোর চলছে। এটা অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু সাধারণ মানুষকে সতর্ক থাকতে হবে, শুরু হতে পারে কুমিরের কান্নায় তাদের নরম মন ভেজাবার অপকৌশল। হারানো তখত ফেরানোর জন্য দুর্জনেরা কত কীই-না করতে পারে! তবে, সেইসঙ্গে ফিরে আসতে পারে ফেলে আসা দুর্দিন, দুর্ভোগও।