তাঁর বক্তৃতায় হামেশাই গঙ্গার দূষণমুক্তি নিয়ে নানা পরিকল্পনা ও প্রতিশ্রুতির কথা শোনা যায়। এই সেদিনও ভোটমুখী রাজ্য উত্তরপ্রদেশের বারাণসীতে একটি প্রকল্পের উদ্বোধন অনুষ্ঠানে মাথায় কলস নিয়ে তাঁকে গঙ্গায় ডুব দিতেও দেখা গেছে। অথচ প্রাপ্য টাকা না দিয়ে বাংলায় গঙ্গার দূষণমুক্তির পরিকল্পনাকে আটকে দেওয়ার চেষ্টা করছে তাঁরই সরকার! একেই বলে বিমাতৃসুলভ আচরণ। আসলে উত্তরপ্রদেশের ভোট বৈতরণী পেরতে মা গঙ্গাকে নিয়েও রাজনীতি করতে ছাড়ছেন না প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। হিন্দুরা গঙ্গার জলকে পবিত্র মনে করে। মনে করে গঙ্গায় ডুব দিলে বা গঙ্গার জল স্পর্শ করলে যাবতীয় পাপক্ষালন হয়। উত্তরপ্রদেশের ভোটে হিন্দুত্বের তাস খেলেই নির্বাচনে উতরে যেতে চাইছে নরেন্দ্র মোদির দল। অনেকেই মনে করছেন, এই কারণেই উত্তরপ্রদেশে মা গঙ্গার উপরই বড় নির্ভরশীল হয়ে পড়েছেন মোদি। কিন্তু বাংলার ভোটে তো তাঁর দল গোহারান হেরেছে। তাই বাংলার গঙ্গা দূষণ নিয়ে তাঁর কোনও মাথাব্যথাও নেই। বরং গঙ্গা সংস্কারের জন্য প্রকল্পের টাকা না দিয়ে বাংলাকে বঞ্চিতই করছে নরেন্দ্র মোদি সরকার। বলা হয়, দূষণের বিচারে বিশ্বের প্রথম পাঁচটি নদীর মধ্যে অন্যতম গঙ্গা। উত্তরপ্রদেশ, বিহার, পশ্চিমবঙ্গের মতো কয়েকটি রাজ্যের লাইফ লাইনও গঙ্গা। এই জাতীয় নদীর পবিত্রতা রক্ষায় তার দূষণমুক্তির জন্য ১৯৮৫ সালে রাজীব গান্ধীর সময়ে গঙ্গা অ্যাকশন প্ল্যান প্রকল্পটি হাতে নেয় কেন্দ্রীয় সরকার। ক্রমাগত বহুমুখী সংস্কার ও সংশোধনের মাধ্যমে গঙ্গার জলকে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখাই ছিল ওই প্রকল্পের মূল উদ্দেশ্য। পরবর্তীকালে এই প্রকল্পটিকে বাড়তি মাত্রা দিতে মোদি এর নাম পরিবর্তন করেন, নমামি গঙ্গে প্রকল্প। গঙ্গা দূষণ রোধে প্রকল্পটির গুরুত্ব বুঝে মোদি সরকার এর বাজেট বরাদ্দও বাড়িয়ে দেয় কয়েকগুণ। লক্ষ্য স্থির হয় ২০২০ সালের মধ্যে গঙ্গা দূষণমুক্ত হবে। কিন্তু সেই ঘোষণাই সার। একাধিক শহরের বর্জ্য বুকে নিয়ে গঙ্গা বইছে একইভাবে। গঙ্গা দূষণ কমাতে মোদি সরকার সত্যিই কতটা আগ্রহী তা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। আরও প্রশ্ন উঠছে, যোগীর উত্তরপ্রদেশে গঙ্গার সংস্কারে কেন্দ্র যতটা উৎসাহী, ততটা তৎপরতা কি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাংলার জন্য দেখা যায়? কারণ দূষণমুক্তির পরিকল্পনা নিয়ে ২০২০ সালে তিনটি ট্রিটমেন্ট প্লান্ট বসানোর প্রকল্প কেন্দ্রের কাছে পাঠিয়েছিল রাজ্য সরকার। ন্যাশনাল মিশন ফর ক্লিন গঙ্গার (এনএমসিজি) অধীনে তার প্রশাসনিক ছাড়পত্রও মেলে। মোট ১৩০৬ কোটি টাকার এই তিনটি প্রকল্প। কিন্তু তারপর বছর গড়িয়ে গেলেও কানাকড়িও মেলেনি। এখানেই কেন্দ্রের বঞ্চনা ও সদিচ্ছা অভাবের সঙ্গত প্রশ্ন উঠেছে। যে প্রকল্পগুলির ১০০ শতাংশ খরচ কেন্দ্রের বহন করার কথা, তার কিছুই না দিয়ে মোদি সরকার বাংলাকে বঞ্চনার আরও একটি নজির তৈরি করেছে।
গঙ্গার জলদূষণ নিয়ে আদালত থেকে পরিবেশবিদ সকলেই উদ্বেগ আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন একাধিকবার। হেলদোল নেই কেন্দ্রের। এব্যাপারে তাদের প্রশাসনিক ব্যর্থতার বহু নজিরও ছড়িয়ে রয়েছে। গঙ্গা দূষণরোধের কাজে গুরুত্ব দিতে কেন্দ্রের যে কতখানি অনীহা তা বাংলার প্রকল্পে বঞ্চনার খতিয়ানেই স্পষ্ট। রাজ্যের তরফে একাধিকবার বলা সত্ত্বেও তিনটি উন্নত পরিকাঠামোযুক্ত সুয়ারেজ ট্রিটমেন্ট প্লান্টের জন্য টাকা না দেওয়ায় স্পষ্ট হয়েছে গঙ্গা দূষণের সমস্যা সমাধানে কেন্দ্র কতটা উদাসীন। সঙ্গতকারণেই প্রধানমন্ত্রী মোদির উত্তরপ্রদেশের গঙ্গাস্নানের প্রসঙ্গে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কটাক্ষ করে বলেছিলেন, ‘ওরা শুধু ভোটের সময়ে গঙ্গাকে মনে রাখে, ভোটের পরে ভুলে যায়...।’ একথা ঠিক, মোদি সরকার তাদের রাজনৈতিক দর্শন অনুযায়ী গঙ্গাকে নিয়ে বেশি সরব ও সক্রিয়। অথচ তারাই গঙ্গা প্রকল্পে বাংলাকে বঞ্চিত করছে! উদ্দেশ্য স্পষ্ট। স্রেফ রাজনৈতিক কারণে এক্ষেত্রেও দ্বিচারিতা করছে কেন্দ্র।
অবশ্য বাংলার প্রতি কেন্দ্রের বিমাতৃসুলভ আচরণ নতুন নয়। বাংলা যেন কেন্দ্রের চোখে দুয়োরানি। আর তাই সবসময়েই তারা ন্যায্য পাওনা থেকে বঞ্চিত রেখেছে পশ্চিমবঙ্গকে। টিকাবণ্টনের ক্ষেত্রেই হোক অথবা প্রাকৃতিক বিপর্যয়—প্রতিটি ক্ষেত্রেই বারবার বৈষম্যের শিকার হয়েছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার। যদিও বিধ্বংসী ঘূর্ণিঝড়ের পর এই রাজ্যে লোকদেখানো পরিদর্শক দল পাঠানো হয়েছিল কেন্দ্রের তরফে। তাঁরা ক্ষয়ক্ষতির রিপোর্টও জমা দিয়েছিলেন। কিন্তু বিপর্যয় মোকাবিলায় বাংলাকে যে অর্থ মঞ্জুর করেছিল কেন্দ্র তা ক্ষতির তুলনায় সামান্য। বঞ্চনার এখানেই শেষ নয়। আসা যাক, টিকাবণ্টন প্রসঙ্গে। সেক্ষেত্রেও দেখা গেছে জনসংখ্যা অনুপাতে বিজেপিশাসিত রাজ্যগুলি বাংলার তুলনায় অনেক বেশি টিকা পেয়েছে। আসলে বাংলাকে দুয়োরানি করেই রাখতে চায় মোদি সরকার। চায় না বাংলার অগ্রগতি, উন্নয়ন। চায় না বাংলা প্রচারের আলোয় আসুক। আর তাই প্রয়াগে কুম্ভমেলার ব্যয়ভার কেন্দ্র বহন করলেও ব্যাপ্তি ঐতিহ্যে তারপরেই থাকা দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম মেলা গঙ্গাসাগরের জন্য কেন্দ্র উপুড়হস্ত হয় না কখনওই। অথচ কেন্দ্র রাজ্য সুসম্পর্কের উপরই দেশের অগ্রগতি নির্ভর করে। গণতন্ত্রের ভিতও হয় মজবুত। কিন্তু মোদি সরকার তা মানতে নারাজ। তাই হয়তো বাংলার প্রতি তাদের এমন দুয়োরানি সুলভ মনোভাব।