একপক্ষ ভোটে দাঁড়িয়েছে, অন্য পক্ষ তার হাতে রাজ্যকে তুলে দিতে যেন ধর্নুভাঙা পণ করেছে। বিজেপি ও নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা নিয়ে অনেক আগেই এ ধরনের অভিযোগ উঠছিল। অভিযোগ ছিল পক্ষপাতিত্বের। এক মাসেরও বেশি সময়ের জন্য বাংলার নির্বাচনের নির্ঘণ্ট সেই অভিযোগকেই মান্যতা দিয়ে মনে করিয়ে দিচ্ছে তারা যেন একযোগে একই মুদ্রার দুই পিঠ। খবরে প্রকাশ, ২৭ মার্চ ভোটের প্রথম দফা থেকে ২২ এপ্রিল ষষ্ঠ দফার মধ্যেই এ রাজ্যে করোনা সংক্রমণ বেড়েছে ১৫ গুণ। এখনও দু’দফা ভোট বাকি। করোনা সংক্রমণ নিয়ে লোকে প্রমাদ গুনলেও মোদি-অমিত শাহের মান রাখতেই কি মরিয়া নির্বাচন কমিশন? বাংলার মানুষের জীবন সুরক্ষায় মরিয়া মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় শেষের দু’দফার ভোট একদিনে করার জন্য কমিশনের কাছে কাতর আর্জি জানিয়েছেন। কিন্তু কাকস্য পরিবেদনা। ভবি ভোলবার নয়। মমতার আর্জি খারিজ করেছে কমিশন। আট দফায় ভোটের কারণে বাংলায় করোনা সংক্রমণের গ্রাফ যে ঊর্ধ্বমুখী হবে সে আশঙ্কা ছিলই। সেই আশঙ্কা থেকেই আট দফায় আপত্তি ছিল তৃণমূল সুপ্রিমোর। মমতার আশঙ্কা যে অমূলক ছিল না তা এখন সত্যি প্রমাণিত হল। তথ্যই তার প্রমাণ। ভোটের ছয় দফায় সংক্রমণের হিসেবে চোখ বোলালেই তা স্পষ্ট। হিসেব বলছে, ২৭ মার্চ দৈনিক আক্রান্ত যেখানে ছিল ৮১২। ২২ এপ্রিল তা বেড়ে হয়েছে ১১৯৪৮। এত দফায় নির্বাচন করোনা সংক্রমণ যে বাড়িয়ে তুলেছে তা অস্বীকার করার উপায় নেই। তা সত্ত্বেও শেষ দু’দফায় ভোট একদিনে সেরে ফেলার যে আর্জি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় করেছেন তাও নাকচ করে দিল কমিশন! ভোটের কাছে মানুষের জীবনের মূল্য যে কত ঠুনকো তা ফের প্রমাণিত হল। মানুষ মরে মরুক, নির্ধারিত নির্ঘণ্ট মেনেই ভোট প্রক্রিয়া চলবে—এই নির্মম নিষ্ঠুর সত্যটি বুঝে গেল আপামর বঙ্গবাসী।
অথচ ভোট প্রক্রিয়া শুধু পশ্চিমবঙ্গেই হচ্ছে না। বাকি চার রাজ্যেও হচ্ছে। মার্চের গোড়ায় নির্বাচনের নির্ঘণ্ট প্রকাশের সময় দেখা যায় অন্য চার রাজ্যে এক থেকে তিন দফায় ভোট শেষ করলেও বিজেপি’র পাখির চোখ পশ্চিমবঙ্গে আট দফায় ভোটের দিন ঘোষণা করেছে কমিশন। যার পরিণতিতে গত এক মাসে জনসভা, রোড শো, মিটিং মিছিলের মতো জনসমাবেশের হাত ধরে করোনা এগিয়েছে রকেট গতিতে। অথচ ভোটের দফা কমিয়ে বড় প্রচারে রাশ টেনে প্রথম থেকেই সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করা যেত। সে পথে হাঁটা হল না। কমিশনের হুঁশ ফেরাতে শেষ তিন দফার ভোটও একদিনে করার প্রস্তাব দিয়েছিলেন মমতা। সেই প্রস্তাবও খারিজ হওয়ার পর শেষ চেষ্টা হিসেবে ২৬ ও ২৯ এপ্রিলের শেষ দু’দফার ভোট একদিনে করার দাবি তোলেন নেত্রী। কিন্তু এত হাহাকার, এত সংক্রমণ, এত আতঙ্কের পরেও কমিশন অনড়! আর বঙ্গ দখলের স্বপ্নে বিভোর বিজেপিও বোবা পুতুল! এমন হঠকারিতার জন্য রাজ্যে যে পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে তার দায় কে নেবে? ভোটের প্রায় শেষ পর্বে এসে প্রচারে রাশ টানার যে উদ্যোগ কমিশন নিল তা আগে কেন করা হল না? প্রশ্ন উঠছে। কোভিড বিধি মানতে বাধ্য করার ক্ষেত্রে দায়সারা মনোভাবের পরিণতি কী ভয়ানক হতে পারে তা এখন স্পষ্ট। নির্বাচন কমিশন কোভিড বিধি সংক্রান্ত গাইড লাইন দিলেও শেষ দু’দফার নির্বাচনের আগে পর্যন্ত তা যথাযথভাবে কার্যকর করার উদ্যোগ নেওয়া হয়নি বলে অভিযোগ। এজন্য সমালোচিতও হতে হয়েছে কমিশনকে। পরিস্থিতি বেগতিক বুঝে ভোটপর্বের একেবারে শেষবেলায় নড়েচড়ে বসল কমিশন। রাজ্যবাসীর দুর্ভাগ্য যে করোনা বিধিকে দুরছাই করে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির পঁচিশটির উপর জনসভা এরাজ্যে হয়েছে। জনসভা থেকে করোনার বিষয়ে মানুষকে সতর্ক করারও প্রয়োজনবোধ করেননি দেশশাসক! প্রচারের একেবারে শেষলগ্নে তাঁর মুখে শোনা গেল করোনার সতর্কবার্তা! যখন বিপদ অনেকটাই বেড়ে গেছে। বিজেপি’র তাবড় নেতাদের বডি ল্যাঙ্গুয়েজই বুঝিয়ে দিয়েছে করোনা মোকাবিলা নয়, বঙ্গ দখল করাকেই তাঁরা অগ্রাধিকার দিচ্ছেন! মমতা কিন্তু রাজ্যবাসীকে সুরক্ষিত করতে বিনামূল্যে ভ্যাকসিন দেওয়ার আশ্বাস বহু আগেই দিয়েছেন। কিন্তু বিজেপি এখন ভোটের স্বার্থে ভ্যাকসিনের টোপ দিয়ে বলছে, বাংলায় ক্ষমতায় এলে বিনামূল্যে ভ্যাকসিন দেওয়া হবে! অথচ দেশবাসীকে সুরক্ষিত রাখতে সকলকে বিনামূল্যে ভ্যাকসিন দেওয়ার দায়িত্বটি প্রধানমন্ত্রী এড়িয়ে গেছেন!
আগাম প্রস্তুতির অভাব ও দেশের সরকারের ব্যর্থতার কারণেই দেশজুড়ে করোনা সংক্রমণের এই ভয়াবহ চিত্র। বাংলা তো করোনার গ্রাফ অনেকটাই নীচে নামিয়ে ফেলেছিল। বাদ সাধল আট দফার ভোট। যা পরিস্থিতিকে ঘোরালো করে দিল। করোনা বিধি পালনে কিছু কাগুজে নির্দেশিকা জারি করে দায় সেরেছে কমিশন। তাদের একগুঁয়ে মনোভাবের মাশুল দিতে হচ্ছে গোটা রাজ্যবাসীকে। আদালতে সমালোচিত হওয়ার পর কোভিড নির্দেশ কার্যকর করতে একেবারে শেষলগ্নে তাদের ঘুম ভাঙল। এই বিলম্বের কারণে যে ক্ষতি হয়ে গেল তার দায় কে নেবে? বিষয়টি আগেই ভাবা দরকার ছিল।