দিনটা প্রতিবছর একবার আসে। ১ জানুয়ারি। ওইদিন ভক্তদের মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করতে কল্পতরু হয়েছিলেন শ্রীরামকৃষ্ণ। সেই থেকে বাঙালির পালাপার্বণে কল্পতরু উৎসব স্থায়ী জায়গা করে নিয়েছে। কিন্তু এই ঘোর কলিকালে নরেন্দ্র মোদি, অমিত শাহ, পীযূষ গোয়েলরা ভোট এলেই ‘রামকৃষ্ণ’ সেজে কল্পতরু হয়ে ওঠেন! প্রতিশ্রুতি দিতে সংবিধানে বাধা নেই। সব প্রতিশ্রুতি পালনের যেন দায়ও নেই তাঁদের। আবার একসঙ্গে অনেক প্রতিশ্রুতি দিলে আমজনতার ভুলে যাওয়ার সম্ভাবনাও থাকে। ফলে ভোট এলে প্রকল্প ঘোষণা আর ‘করে দেব’-র আপ্তবাক্য চলতেই থাকে। আগামী মে মাসের মধ্যে পশ্চিমবঙ্গ সহ পাঁচ রাজ্যের ভোট। হয়তো প্রধানমন্ত্রীর আরও কিছু ঘোষণা বাকি। নিন্দুকেরা বলছে, জনতাকে আবারও কিছু প্রতিশ্রুতি দেবেন বলে নাকি ভোটের দিন ঘোষণাও বারবার পিছিয়ে যাচ্ছে। তবে খবরে প্রকাশ, চলতি মাসের শেষ সপ্তাহ পর্যন্ত সরকারি প্রকল্প ও শিলান্যাসে হয়তো ব্যস্ত থাকবেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। তারপরই সম্ভবত ভোটের দিন ঘোষণা হতে পারে। ২৪ ফেব্রুয়ারি ভোটের দিন ঘোষণার ইঙ্গিতও রয়েছে। তার আগে পর্যন্ত শিলান্যাস করা বা প্রকল্প ঘোষণার আদর্শ সময়। মোদি সরকারের সেকেন্ড ইন কমান্ড অমিত শাহ-ও প্রতিশ্রুতি দানে পিছিয়ে নেই। ভোটের রাজ্য পশ্চিমবঙ্গে ঘনঘন এসে দফায় দফায় প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন। সরকারের শীর্ষ পদাধিকারীদের অনুসরণ করে ‘ডোল’ বিলিতে নেমে পড়েছেন রেলমন্ত্রী পীযূষ গোয়েলও। সেইসঙ্গে ‘বাড়তি আকর্ষণ’ সরকারি অনুষ্ঠানের মঞ্চ থেকেই নাম না করে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও তাঁর সরকারের বিরুদ্ধে তোপ দাগা! ঘটনা হল, ভক্তদের আশা আকাঙ্ক্ষা পূরণের দায় নিয়েছিলেন রামকৃষ্ণ। ভক্তদের জন্য অকাতরে সবকিছু বিলিয়ে তিনি হয়েছেন ঠাকুর। এই রাজনৈতিক নেতাদের অবশ্য সে দায় নেই। তাই রাজনৈতিক নেতাদের ‘কল্পতরু’ হয়ে প্রতিশ্রুতি বিতরণে চমকদারি থাকলেও উঠছে তাঁদের কার্যক্রম নিয়ে বিশ্বাসযোগ্যতার প্রশ্ন। আরও প্রশ্ন। কেন বারবার সরকারি অনুষ্ঠানের মঞ্চকে রাজনৈতিক প্রচারের মঞ্চ হিসাবে ব্যবহার করা হচ্ছে? প্রধানমন্ত্রী মোদির উপস্থিতিতেই নেতাজি জন্মজয়ন্তী পালনের সরকারি সূচনা অনুষ্ঠানে দেওয়া হল দলীয় স্লোগান ‘জয় শ্রীরাম’! সেই স্মৃতিই ফিরে এল জাতীয় গ্রন্থাগারে আয়োজিত কেন্দ্রীয় সংস্কৃতি মন্ত্রকের স্বাধীনতা সংগ্রামীদের শ্রদ্ধাজ্ঞাপন অনুষ্ঠানে। সেখানেও উঠল ‘জয় শ্রীরাম’ ধ্বনি। মঞ্চে উপস্থিত কেন্দ্রের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ। সরকারি অনুষ্ঠানে এমন ‘দলীয়’ স্লোগানকে ঘিরে যতই বিতর্ক দানা বাঁধুক প্রধানমন্ত্রী সেদিন প্রতিবাদ না করে চুপ করেই ছিলেন। ফের প্রায় একই ঘটনার সাক্ষী রইল ঐতিহ্যবাহী জাতীয় গ্রন্থাগার। অনেকে বলছেন, ‘জয় শ্রীরাম’ কোনও রাজনৈতিক স্লোগান নয়। যদিও বিজেপির প্রতিটি সভা সমিতিতেই নেতাদের মুখে ‘জয় শ্রীরাম’ ধ্বনি শোনা যায়। উদ্দেশ্য স্পষ্ট। অনেকেই মনে করছেন, ধর্মীয় মেরুকরণের উদ্দেশ্যেই এই স্লোগানকে বিজেপি কাজে লাগাতে চাইছে।
রাজ্য সরকারকে বিঁধতে সরকারি অনুষ্ঠানের মঞ্চকে ব্যবহার করার কাজে কয়েক কদম এগিয়ে রইলেন রেলমন্ত্রী পীযূষ গোয়েল। ভিক্টোরিয়া বা জাতীয় গ্রন্থাগারের সরকারি কর্মসূচিতে বিজেপির কর্মী সমর্থকরা ‘জয় শ্রীরাম’ ধ্বনি তুলে অনুষ্ঠানকে রাজনৈতিক রূপ দেওয়ার চেষ্টা করেছিল। তাতে অনুষ্ঠানের গরিমা ক্ষুণ্ণ হয়েছে। বিতর্ক হয়েছে। তবে সে দায় বর্তেছিল দর্শকদের একাংশের ঘাড়ে। কিন্তু এবার সরকারি মঞ্চকে ব্যবহার করে রেলমন্ত্রী যেভাবে রাজ্য সরকারকে বিঁধলেন তাতে সৌজন্য শিষ্টাচার কোনওটাই বজায় রইল না। নিমতিতা স্টেশনে বোমা বিস্ফোরণের ঘটনা প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন, ‘বাংলায় হিংসার পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে’। আশ্চর্যজনকভাবে এটা বলার জন্য বেছে নিয়েছেন সরকারি মঞ্চকে! ভোটের মুখে একথা বলে তিনি কার্যত বাংলার আইনশৃঙ্খলার অবনতির প্রসঙ্গ তুলে তোপ দাগলেন। এখানেই থেমে থাকেননি। ওই বিস্ফোরণের ঘটনা প্রসঙ্গে সম্ভবত মন্ত্রীমশাইয়ের হোমওয়ার্কটাও ভালো ছিল না। তাই এমন একটি বেফাঁস মন্তব্য করে বসলেন যা নিয়ে ফের বিতর্ক। ঘটনাটিকে ‘দুর্ভাগ্যজনক’ আখ্যা দিয়ে তিনি বলেছেন, ‘কিছু সমাজবিরোধীর ছোড়া বোমায় রাজ্যের একজন মন্ত্রী সহ অনেকে আহত হয়েছেন। একজন মারাও গিয়েছেন’। বিতর্ক এই ‘মৃত্যু’ নিয়ে। কোনও দায়িত্বশীল মন্ত্রী সঠিক তথ্য দেবেন সেটাই প্রত্যাশিত। সত্যিই কেউ কি ওই ঘটনায় মারা গিয়েছেন? তা না জেনে এধরনের মন্তব্য করা অনুচিত। তৃণমূল তাই একে ‘অসত্য তথ্য’ পরিবেশন হিসেবে দেখে ভোটের মুখে বাংলার মানুষকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা বলেই মনে করছে।
এবারের রেল বাজেটে বাংলার গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পগুলির অধিকাংশতেই বরাদ্দ যৎসামান্য। যদিও শুক্রবার তিনি পশ্চিমবঙ্গের জন্য একগুচ্ছ রেলযাত্রী পরিষেবা ও প্রকল্পের উদ্বোধন করেছেন। যাকে ভোটের মুখে মানুষের মন জয় করার প্রয়াস বললে অত্যুক্তি হবে না। কারণ রেলযাত্রী পরিষেবার কী হাল তা ভুক্তভোগী মাত্রই জানেন। তাই উন্নত পরিষেবার দিকে আরও আগে নজর দেওয়াটা জরুরি ছিল।