ভারতের কোভিড ব্যবস্থাপনা নিয়ে গবেষণা হওয়া উচিত। মনে করেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। সম্প্রতি একটি ম্যানেজমেন্ট শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অনুষ্ঠানে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী এই ব্যাপারে তাঁর বক্তব্য রাখেন। তাঁর বক্তব্যের সারকথা হল, ১৩০ কোটির বেশি মানুষের দেশ ভারত অর্থনীতিকে সচল রেখে যেভাবে কোভিড মোকাবিলা করছে তা একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। তাঁর দাবি, এনিয়ে উপযুক্ত গবেষণা হওয়া উচিত। সবটাই নথিবদ্ধ হওয়া দরকার। বিশেষ করে ম্যানেজমেন্ট যাঁদের চর্চার বিষয় তাঁরাই এই বিষয়ে এগিয়ে আসুন। প্রধানমন্ত্রী ঠিকই বলেছেন। তবে তিনি যেটা বলেননি, তা হল—এই বিষয়ে প্রতিটি রাজ্যের ভূমিকাও বিস্তারিত বিশ্লেষণের দাবি রাখে। কারণ, ভারতের মতো বৃহৎ যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোয় রাজ্যগুলির ভূমিকা আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ। কেন্দ্র একা কিছুই করতে পারে না। সাংবিধানিকভাবে যে দায়িত্বগুলি রাজ্যের একার এক্তিয়ারভুক্ত সেগুলি রাজ্যই করে থাকে। যৌথ তালিকাভুক্ত বিষয়গুলিও রাজ্য সম্পন্ন করে, কেন্দ্রের সাহায্য নিয়ে। বস্তুত দেশ গঠনের মূল কাজে রাজ্যগুলির ভূমিকা অনবদ্য। সাফল্যের সঙ্গে কোভিড মোকাবিলাতেও রাজ্যগুলির প্রশংসা প্রাপ্য। বিশেষ করে যেসব রাজ্য অর্থনীতির চাকা দ্রুত মোটামুটি সচল করে তুলতে পেরেছে তাদের কৃতিত্ব দিতেই হবে। এই প্রশ্নে আমাদের রাজ্য পশ্চিমবঙ্গের ডবল ক্রেডিট পাওয়ার কথা। কারণ, কোভিড যখন সারা ভারতকে প্রায় পেড়ে ফেলেছে ঠিক সেইসময় বাংলার বুকে আছড়ে পড়েছিল বিধ্বংসী উম-পুন। কলকাতা মহানগরীসহ দক্ষিণবঙ্গের বিস্তীর্ণ অংশ ওই ঘূর্ণিঝড়ে বিধ্বস্ত হয়ে যায়। স্মরণকালের মধ্যে কলকাতার বুকে এমন ভয়ানক প্রাকৃতিক বিপর্যয় এটাই প্রথম। প্রধানমন্ত্রী দেখে গিয়েছিলেন। কথা দিয়েছিলেন, তাঁর সরকার বাংলার মানুষের পাশে থাকবে। কিন্তু যথারীতি কথা রাখেননি প্রধানমন্ত্রী। ‘একলা চলো রে’ মন্ত্র পাথেয় করে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার সেই বিপর্যয় থেকে বাংলাকে উদ্ধার করেছে। 
মনে রাখতে হবে, কোভিড এবং উম-পুন দু’টি বিরাট বিপর্যয়কে একসঙ্গে সামলাতে হয়েছে তাঁকে। তার পরেও দেখা যাচ্ছে, দেশের মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদন (জিডিপি) বৃদ্ধিতে বাংলার ভূমিকা বিশেষভাবে উজ্জ্বল। বিভিন্ন সমীক্ষা থেকে অর্থমন্ত্রক যে রিপোর্ট পেয়েছে তাতে দেখা যাচ্ছে, জিডিপি বৃদ্ধিতে ছয়টি রাজ্যের মোট অবদান অর্ধেকের বেশি। আর ওই অগ্রণী ছয় রাজ্যের মধ্যে রয়েছে পশ্চিমবঙ্গ। তামিলনাড়ু, মহারাষ্ট্র, কর্ণাটক, উত্তরপ্রদেশ, গুজরাত ও পশ্চিমবঙ্গ সবচেয়ে এগিয়ে রয়েছে জিএসটি আদায়, পণ্য বিক্রয়, ঋণগ্রহণ এবং আর্থিক লেনদেন বৃদ্ধির হারে। গত কয়েক মাসে এই রাজ্যগুলি শিল্প-বাণিজ্য এবং জীবিকার স্বাভাবিক অবস্থার ৮৭ শতাংশ অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের এই অগ্রগতির বেশিরভাগটাই অর্জিত হয়েছে মোটামুটি কোভিড পরিস্থিতিতে। যে চারটি রাজ্যে অর্থনীতি সবচেয়ে তাড়াতাড়ি চাঙ্গা হয়ে উঠেছে তার মধ্যেও রয়েছে পশ্চিমবঙ্গ। কোভিড পরিস্থিতিতে সবচেয়ে বেশি ধাক্কা খেয়েছে কাজের বাজার। অস্থায়ী তো বটেই স্থায়ী চাকরিও খুইয়ে মাথায় হাত দিয়ে বসেছেন লাখো লাখো ভারতবাসী। অসংখ্য কর্মচ্যুত পরিযায়ী শ্রমিক বাড়ি ফিরে গিয়েছিলেন। এর প্রভাবে রাজ্যে রাজ্যে অর্থনীতি ভেঙে পড়ার অবস্থা হয়েছিল। 
সেখানেও পশ্চিমবঙ্গ এক ব্যতিক্রমী রাজ্য হিসেবে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে। শ্রমমন্ত্রকের অধীন ইপিএফও-র তথ্য অন্তত সেই সাক্ষ্য দিচ্ছে। পিএফের তথ্য থেকে জানা যাচ্ছে, গত এপ্রিল-অক্টোবর পর্বে বাংলায় বেসরকারি ক্ষেত্রে ১ লক্ষ ২০ হাজার যুবক-যুবতীর নতুন চাকরি হয়েছে। অর্থাৎ প্রতি মাসে বেসরকারি চাকরি হয়েছে গড়ে ১৭ হাজারের বেশি। এপ্রিল-মে, সারা দেশে পুরোপুরি লকডাউন ছিল। ওই দু’মাসেও বাংলায় অল্প হলেও নতুন চাকরি হয়েছে! অবিশ্বাস্য শোনালেও এটা যে নিখাদ সত্যি, সেটাই জানাচ্ছে কেন্দ্রীয় মন্ত্রক। মনে রাখতে হবে, নভেম্বর ও ডিসেম্বরে হওয়া নতুন চাকরির হিসেবটা এর মধ্যে নেই। এছাড়া খুব ছোট বেসরকারি সংস্থাগুলি কিন্তু পিএফের আওতার বাইরে। তাই গত কয়েক মাসে ওই ধরনের শিল্প-ব্যবসা ক্ষেত্রে যত চাকরি হয়েছে তা এই হিসেবের বাইরে রয়ে গিয়েছে। অর্থাৎ বাংলার সাম্প্রতিক সমগ্র আর্থিক চিত্রটি অনেক বেশি উজ্জ্বল। আর সেটাই গর্বের বাস্তব। এই কৃতিত্ব বাংলার নেত্রী, বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের। রাজ্য সরকারের এই সাফল্য স্পষ্ট করে দেয়, বিরোধীদের সমালোচনার বেশিরভাগটাই অন্যায্য। ভোটের কথা মাথায় রেখে তারা বিরোধিতার জন্যই বিরোধিতা করছে মাত্র। প্রধানমন্ত্রীর কথার সূত্র ধরে বলতে হয়, কোভিড মোকাবিলায় বাংলার এই অসামান্য ভূমিকা নিয়ে অদূর ভবিষ্যতে বিস্তারিত গবেষণা হোক।