নাড়ি টিপে রোগ নির্ণয়। একটা সময় ছিল যখন অভিজ্ঞ চিকিৎসকরা নাকি রোগীর নাড়ি ধরে বলে দিতে পারতেন তার কী রোগ হয়েছে। এভাবেই তাঁরা রোগীর শারীরিক ও মানসিক পরিস্থিতি বোঝার চেষ্টা করতেন। কারণ তখন এখনকার মতো নানারকম মেডিকেল টেস্ট করানোর সুযোগ সবার ছিল না। টেস্ট নির্ভর চিকিৎসা পদ্ধতির বদলে অভিজ্ঞতা নির্ভর চিকিৎসাই বেশি হতো। এখনও তাই বহু বাড়ির বয়স্ক মানুষকে সেসময়ের চিকিৎসকদের গুণকীর্তন করতে শোনা যায়। তাঁদের চোখে চিকিৎসকরা ধন্বন্তরি। শুধু চিকিৎসাক্ষেত্রেই বা বলা কেন, প্রায় সবক্ষেত্রেই অভিজ্ঞতার মূল্যকে হেলাফেলা করার নয়। অভিজ্ঞতার সঙ্গে দক্ষতার মেলবন্ধন ঘটানো সম্ভব হলে অনেক সমস্যা উতরে যাওয়া যায় সহজে। তবে সমস্যাটি ঠিক কী, তার অবস্থান কত গভীরে তা বোঝার জন্য বাস্তবের সঙ্গে যোগ থাকাটা জরুরি। আমাদের দেশের বহু রাজনৈতিক নেতা-মন্ত্রীর মধ্যে সেই যোগসূত্রটাই অনুপস্থিত। বাস্তবের মাটিতে পা রেখে তাঁরা হাঁটেন না, দূর থেকে সবকিছু দেখেন, ওপর ওপর সমস্যা বোঝার চেষ্টা করে চটজলদি সমাধানের উপায় খোঁজার চেষ্টাও করেন। মন্ত্রিত্ব লাভের পর মাটির সঙ্গে যোগাযোগ হয় বিচ্ছিন্ন অথবা কম। রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ব্যতিক্রম। বাস্তবকে সঙ্গী করেই তাঁর পথ চলা। তিনি নাকি খেলা-মেলা-উৎসব নিয়েই মেতে থাকেন। বিরোধীদের অভিযোগ অন্তত তেমনই। জীবনযুদ্ধে অক্সিজেনের ন্যায় এসবেরও যে প্রয়োজন আছে, তা তাঁর থেকে ভালো আর কে বোঝেন? করোনার জেরে ভেঙে পড়া অর্থনীতির চাকা ঘোরাতে হলে ঠিক কী করা প্রয়োজন, তা বোঝার জন্য চাই দূরদর্শিতা। চাই বাস্তবমুখী চিন্তাভাবনা। বাস্তবের সঙ্গে সেই যোগের কারণেই আনলক পর্ব শুরু হতেই তিনি করোনা মোকাবিলার পাশাপাশি রাজ্যকে যতটা সম্ভব সচল করার আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন। তা নিয়ে কম সমালোচনার মুখে পড়তে হয়নি তাঁর সরকারকে। তবু কেনাকাটার সুযোগ প্রসারিত করেছিলেন। খুলে দিয়েছিলেন দোকানপাট। বেচাকেনা বাড়লে তার প্রভাব অর্থনীতিতে পড়তে বাধ্য। বাস্তবমুখী এই চিন্তার ফল 
হাতেনাতে পেয়েছে বাংলা। জিএসটি আদায়ে রাজ্য সরকারের পাকাপোক্ত অবস্থানের কারণেই উজ্জ্বল হয়েছে বাংলার মুখ। দেশের অন্যান্য বহু রাজ্যকে পিছনে ফেলে বাংলার অর্থনীতির চাকা ভালোই ঘুরেছে। শুধু 
তাই নয়, এই করোনাকালেও গত বছরের অক্টোবর-নভেম্বরের 
তুলনায় এবছর রাজ্যে জিএসটি সংগ্রহ বেশি হয়েছে। কোভিড বিপর্যয় পর্বেও গত বছরের নভেম্বরের তুলনায় এবছর সেইসময়ে বাংলায় জিএসটি আদায় ৮ শতাংশ বেশি হয়েছে। এই তথ্যটি মনগড়া নয়, আশার কথাটি অর্থমন্ত্রকের পরিসংখ্যানে স্পষ্ট।
মমতা জমানায় বাংলার ‘সর্বনাশ’ হয়ে যাচ্ছে বলে যাঁরা গেল গেল রব তোলেন তাঁদের কাছে অবশ্যই বাংলার জিএসটি সংগ্রহের বিষয়টি দৃষ্টান্ত হতে পারে। কারণ যেখানে দেশে গত মাসে জিএসটি আদায় কমেছে প্রায় ২০০ কোটি টাকা, সেখানে বাংলা নভেম্বরেই বাড়তি ৯ কোটি টাকা জিএসটি আদায় করেছে। এটা বড় সাফল্য। বলার অপেক্ষা রাখে না, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের অর্থনৈতিক সংস্কারের ফলেই জিএসটি সংগ্রহ গতি পেয়েছে। যে-কোনও রাজ্যের কাছেই বাংলার মুখ্যমন্ত্রীর মস্তিষ্কপ্রসূত সামাজিক সুরক্ষা প্রকল্পগুলি অনুপ্রেরণা হতে পারে। কারণ এর সুফল ভোগ করছেন রাজ্যের অসংখ্য মানুষ। সেইসঙ্গে জিএসটি আদায়ের 
ক্ষেত্রে বাংলার ঊর্ধ্বমুখী গ্রাফ যথেষ্ট উৎসাহব্যঞ্জক। কেনাকাটা এবং আর্থিক লেনদেনে গুরুত্ব আরোপের কারণেই জিএসটি সংগ্রহে 
বিজেপি শাসিত অথবা তার সহযোগী শাসিত সাত রাজ্যকে পিছনে ফেলে এগিয়ে রয়েছে বাংলা। এমনকী, বামশাসিত কেরলও বাংলার থেকে পিছিয়ে রয়েছে। রাজস্ব বৃদ্ধির ক্ষেত্রে এনডিএ শাসিত বেশ কয়েকটি রাজ্য নভেম্বরে ‘মাইনাসে’ পৌঁছেছে। এর মধ্যে আছে যোগীর রাজ্য উত্তরপ্রদেশ, নীতীশ কুমারের বিহারও।
দেশ ও রাজ্যের অগ্রগতির প্রয়োজনে রাজস্ব বৃদ্ধি একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এর জন্য দরকার উপযুক্ত নীতিগ্রহণ। কেন্দ্রীয় নীতির কারণে, কোভিডের আগেই, দেশের অর্থনীতি বেহাল হয়ে পড়েছিল। করোনার ধাক্কায় তা আরও খারাপ হয়। মানুষের হাতে নগদের জোগান থাকলে দেশের অর্থনীতি হয়তো এতটা ভেঙে পড়ত না। কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকার মানুষের হাতে নগদের জোগান বাড়ানোর চেষ্টা বিন্দুমাত্র করেনি। ফলে সারা দেশে পণ্য বিক্রি কমেছে। চাহিদা না-থাকায় পণ্যের উৎপাদন ও সাপ্লাই কমেছে। ফলে কমেছে জিএসটি আদায়। কিন্তু এই সমস্যাটির আগাম আঁচ পেয়ে উল্টো পথে হেঁটেছে বাংলা। লকডাউনে ঝিমিয়ে-পড়া মার্কেটকে সচল রাখার চেষ্টা করেছে। তাতে জিনিসপত্রের বিক্রি বেড়েছে। স্বভাবতই বেড়েছে জিএসটি আদায়। অর্থনীতিকে চাঙ্গা করার এমন সহজ দাওয়াইয়ে বাজিমাত করেছে আমাদের রাজ্য, যা কেন্দ্রীয় শাসক এবং অন্য রাজ্যগুলির কাছেও শিক্ষণীয় হতে পারে।