জাতীয় সড়ক ধরে এগলে হালকা হাওয়ায় দুলতে থাকা কাশফুল চোখে পড়ছে। গ্রাম বাংলার আনাচে-কানাচে শিউলি ফুলের গন্ধ জানান দিচ্ছে দেবীপক্ষ শুরু হয়ে গেছে। সেই পুজো মণ্ডপ, সেই আলোর বাহার, সেই একচালা থেকে নানা বিহঙ্গে মায়ের রূপ। তবু কোথায় যেন ছন্দ কেটে গেছে। এবার এক অন্য পুজোর সাক্ষী বাংলা।
সাধারণ নিয়মে আশ্বিনের শারদ প্রাতে মহালয়ার পুণ্য লগ্ন থেকে শুরু হয়ে যায় দেবীপক্ষ। মায়ের বোধন হয় সাতদিন পর ষষ্ঠীতে। এবার শুরুতেই তাল কেটেছে। ষষ্ঠীর সকালেই আকাশের মুখ ভার। পঞ্জিকা মেনে এবার মহালয়ার পরদিন থেকে শুরু হয়েছে মলমাস। তাই এবার ৩৫ দিন অপেক্ষার পর মায়ের বোধন হল। কিন্তু এ তো নিছক নিয়মের বেড়াজাল। এবার উৎসবের আনন্দে প্রাণ খুলে মেতে থাকার ইচ্ছায় যেন বেড়ি পরিয়ে দিয়েছে করোনা। এক করোনা ভাইরাসের সংক্রমণে গোটা দুনিয়া পদানত। ব্যতিক্রম নয় বাংলাও। দৈনিক চার হাজারের বেশি নতুন মানুষের সংক্রমণ নিয়ে সে রক্তচোখ দেখাচ্ছে। বিশেষজ্ঞ থেকে কেন্দ্র ও রাজ্যের প্রশাসন—সকলে একমত জীবনের চেয়ে উৎসব বড় হতে পারে না। অতএব রাশ টানতে হবে লাগাম ছাড়া আনন্দে। সংক্রমণ যাতে আরও ছড়িয়ে না পড়ে সেজন্য মণ্ডপে একসঙ্গে জড়ো হওয়া যাবে না বলে জানিয়েছে মহামান্য আদালত। মণ্ডপ থাকবে দর্শকশূন্য। সতর্ক থাকতে হবে। থাকতে হবে সংযত। অঙ্গ সজ্জায় মাস্ক আর প্রসাধনের তালিকায় স্যানিটাইজার রাখতেই হবে। এইভাবে সকলে বিধি নিষেধ মানলে মারণ রোগের হাত থেকে বাঁচানো যাবে নিজেকে, অন্যদেরও। গোটা জীবনে মাত্র একটা পুজোর আনন্দ উচ্ছ্বাসে একটু রাশ টানলে জীবন বৃথা হয়ে যায় না। ভিড়ভাট্টায় গিয়ে সংক্রামিত হওয়ার চেয়ে একটু সতর্ক থাকা ভালো নয় কি। এমনিতেই এখন কিছু হাসপাতালে ঠাঁই নাই, ঠাঁই নাই রব ওঠার উপক্রম। করোনা ছাড়াও অন্য রোগীরা চিকিৎসার সমস্যায় পড়ছেন। গুরুত্বপূর্ণ কিছু অপারেশনের কাজ কখনও বা থমকে যাচ্ছে করোনার কোপে। মাসের পর মাস টানা চিকিৎসা পরিষেবা দিয়ে চিকিৎসকদের অনেকেই ক্লান্ত। তারপরও কি আমরা ভাবব না আমাদের কি করণীয়? জনপ্লাবনের স্রোতে ভেসে গিয়ে বিপদ বাড়াব, নাকি প্রার্থনা করব বাড়ি বসেই? উৎসবের মরশুমে দেশবাসীকে সতর্ক করে দিয়ে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বলেছেন, বেপরোয়া হওয়ার সময় এটা নয়। জাতির উদ্দেশে ভাষণে দুর্গাপুজো বাদ গেলেও পরে তিনি ট্যুইট করে বঙ্গবাসীকে শারদ শুভেচ্ছাও জানিয়েছেন। শুভেচ্ছা জানিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। পুজোকে কেন্দ্র করে স্থানীয় মানুষের আবেগ সুরক্ষিত রাখতেই মণ্ডপে দল বেঁধে দর্শনার্থী প্রবেশে আদালতের নিষেধাজ্ঞা থাকলেও দূর থেকে দফায় দফায় অঞ্জলি দেওয়ার সুযোগ তো থাকছে। পুজো পরিচালনায় লোকবল কিছুটা বাড়ানোর অনুমতি দিয়েছে আদালত। পূর্ব নির্দেশিকায় আংশিক ছাড় দিয়ে বলা হয়েছে, বড় পুজো প্যান্ডেলে ৬০ জনের নাম তালিকায় রাখা যাবে। তবে একসঙ্গে ৪৫ জনের বেশি প্রবেশ নিষেধ। ঢাকের বাদ্যি ছাড়া পুজো আবার হয় নাকি? তাঁদের জন্যও ব্যবস্থা আছে। ঢাকিরা থাকবেন ‘নো এন্ট্রি জোনে’। তবে মাস্ক ও অন্যান্য প্রোটোকল মানতেই হবে। বিপদ এড়াতে এটুকু সাবধান হতেই হবে। সচেতন নাগরিকরা তা অবশ্যই বুঝেছেন। তাই গত কয়েক বছরের মতো এবার চতুর্থী বা পঞ্চমীর রাতে বহু পুজো মণ্ডপেই সেরকম ভিড় দেখা যায়নি। ব্যতিক্রমও ছিল। লোকাল ট্রেন চলাচল বন্ধ, সেইসঙ্গে আদালতের নিষেধাজ্ঞা। তাই হয়তো এমন। এখনও সেরকম জনপ্লাবনে ভেসে যায়নি রাজপথ। তবে মণ্ডপ দর্শনের জন্য ব্যারিকেডের বাইরে থেকে উঁকিঝুঁকির চেষ্টা যে একেবারেই হয়নি তাও নয়। নামী কিছু মণ্ডপের সামনে ব্যারিকেডের ধারে ভিড়ও হয়েছে। প্রতিমা দর্শনের সুযোগে খামতি নেই। তবে বাইরের লোক আটকাতে অনেক বনেদি বাড়ি এবার দরজায় আগল দিচ্ছে অথবা নিচ্ছে বিকল্প ব্যবস্থা। একদিকে করোনা সংক্রমণ, অন্যদিকে হাওয়া অফিসের ভারী বর্ষণের পূর্বাভাস কিন্তু আশঙ্কা জিইয়েই রেখেছে। এবার পুজো একটু অন্যরকম।
তাই সুরক্ষাবিধি মেনে আনন্দ করুন, কিন্তু উদ্‌যাপন নয়। উৎসবের আনন্দে ভেসে যাওয়া নয়। সতর্ক থেকে পা ফেলুন রাস্তায়। আমাদের প্রীতি ও শুভেচ্ছা রইল আপনার সঙ্গে।