শাক দিয়ে মাছ ঢাকা যায় না। মোদি সরকার বার বার সেই চেষ্টাই করে চলেছে আর ব্যর্থও হচ্ছে। আসল সত্যটি অর্থাৎ ভারতের অর্থনীতির বেহাল দশা ক্রমশ প্রকট হচ্ছে। স্বাধীনতার পর এমন দুর্দিন সম্ভবত দেখতে হয়নি ভারতবাসীকে। এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাঙ্ক (এডিবি) তাদের সাম্প্রতিক রিপোর্টে যে পূর্বাভাস দিয়েছে তাতে আশঙ্কা আরও বাড়ল। চলতি আর্থিক বছরে বৃহত্তর অর্থনৈতিক মন্দায় পড়তে চলেছে ভারত। ভারতের অর্থনীতি ক্রমশ ডুবছে বলে আগেই ইঙ্গিত দিয়েছিলেন দেশের নানা বাণিজ্যিক সংগঠন, বিভিন্ন গবেষণা সংস্থা এবং অর্থনৈতিক পণ্ডিতদের অনেকে। কিন্তু কেন্দ্রের মোদি সরকার তাঁদের বক্তব্যকে ধর্তব্যের মধ্যে নেয়নি। উল্টে তাঁদের বক্তব্যে আমল না দিয়ে এমন সব নীতি গ্রহণ করেছে যার মাশুল দিতে হচ্ছে দেশবাসীকে। এডিবি-র পূর্বভাস চার দশকের সবচেয়ে বড় অর্থসঙ্কট আসছে ভারতে। আর্থিক বৃদ্ধির হার মাইনাস ৯ হতে পারে। এই পূর্বভাস সবচেয়ে আশঙ্কা বাড়াচ্ছে দেশের আম জনতার। কারণ কোনও দেশে আর্থিক মন্দা হলে সবার আগে তার প্রভাব পড়ে মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত শ্রেণীর উপর। আর প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির জমানায় এই শ্রেণীর স্বার্থই সবচেয়ে বেশি উপেক্ষিত থেকেছে। বিরোধীরা বার বার অভিযোগ করেছে, দেশের এখনকার সরকার বরাবরই ধনী শ্রেণীর স্বার্থরক্ষার নীতি গ্রহণ করেছে। গবির, মধ্যবিত্ত থেকে গেছে উপেক্ষিত। গরিব আরও গরিব হয়েছে। তাই দেশে আর্থিক মন্দা দেখা দিতে পারে বলে এডিবি’র রিপোর্ট উদ্বেগ তাদেরই বাড়াচ্ছে বেশি। কারণ যে শ্রেণীর আয়ের পরিমাণ কম, বিশেষত ক্ষুদ্র ও অতি ক্ষুদ্র শিল্পের সঙ্গে যুক্ত ব্যবসায়ীরা এতে ধাক্কা খাবেন অনেকটাই। শুধু তাই নয়, এতে ধাক্কা খাবে দেশি-বিদেশি লগ্নিও।
মোদি সরকারের একের পর এক অপরিকল্পিত সিদ্ধান্তের জেরে ভুগতে হচ্ছে সাধারণ মানুষকে। নোটবন্দির সিদ্ধান্তটি যে সঠিক ছিল না তা স্পষ্ট হয়েছে। কালো টাকার রমরমা বন্ধ হয়নি। সেই সিদ্ধান্তের জের সামলে ওঠার আগেই করোনার কারণে আরও বিপর্যস্ত হয়েছে দেশের অর্থনীতি। এই ধাক্কা সামলাতে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে কী করণীয় যে বিষয়ে প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং বা প্রাক্তন অর্থনীতিবিদ পি চিদম্বরম তাঁদের গুরুত্বপূর্ণ মতামত প্রকাশ করলেও সে ব্যাপারে কর্ণপাত করেনি দেশের শাসক দল। তাঁরাও আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন, এভাবে চললে ভারতের অর্থনীতি ক্রমশ ডুববে। বাড়বে বেকার সংখ্যা। আশঙ্কা যে অমূলক ছিল না তা এখন বোঝা যাচ্ছে। সরকারের গালভরা নানা ঘোষণায় সত্যিই দেশের মানুষ কতটা উপকৃত হচ্ছেন? বলা শক্ত। তবে ঋণ দেওয়ার সরকারি স্কিম ঋণভারে জর্জরিত সংস্থাগুলোর ঋণভার যে আরও বাড়বে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। করোনা আবহে লকডাউনের সিদ্ধান্তের সুফল মিলেছে বলে সরকার দাবি করলেও অস্বীকার করার উপায় নেই ‘অপরিকল্পিত’ লকডাউনের জেরে বহু মানুষ বেকার হয়ে পড়েছেন। এডিবি রিপোর্টেও আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে, অনুৎপাদী ঋণের পরিমাণ বিপুল বেড়ে যাওয়ায় অর্থাৎ এই লকডাউন ও অর্থনৈতিক স্তব্ধতার কারণে ব্যাঙ্ক ও আর্থিক সংস্থাগুলি থেকে গ্রহণ করা ঋণ পরিশোধ যথেষ্ট ধাক্কা খাবে। লাগাতার এবং বিক্ষিপ্ত লকডাউনের ফলে ভারতের অর্থনৈতিক কাজকর্ম যেভাবে স্তব্ধ হয়ে গিয়েছে সেটা থেকে ঘুরে দাঁড়াতে সময় লাগবে।
একথা ঠিক, যে-কোনও বিপর্যয় এলে তা সামলে ঘুরে দাঁড়াতে সময় লাগে। এই ঘুরে দাঁড়ানোর জন্যও দরকার সঠিক পরিকল্পনার। অতীতেও ভারতের অর্থনীতি চরম সঙ্কটে পড়েছে। ১৯৭৯-৮০ আর্থিক বছরে ভারতের আর্থিক বৃদ্ধি হার নেগেটিভ হয়েছিল। সেই বিপর্যয় কাটিয়ে কিন্তু ভারত ঘুরে দাঁড়িয়েছে। সে ইতিহাসও আমাদের আছে। তাই, বিপর্যয় সামলানোর জন্য দরকার সরকারি তরফে সঠিক পদক্ষেপ গ্রহণ এবং প্রয়োজনীয় সুপরামর্শগুলি গ্রহণ করার মানসিকতা। কম আয়ের শ্রেণী ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের জন্য বিশেষ সহায়তা যে আবশ্যক তা এডিবি’র রিপোর্টেও ঠাঁই পেয়েছে। দেশের বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদের অনেকে এমন মতামত আগেই ব্যক্ত করেছেন যা কেন্দ্রের সরকার গ্রাহ্যের মধ্যে আনেনি। তাই আশঙ্কা যখন রয়েছে তখন আর কোনও হঠকারী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা সরকারের উচিত হবে না। অর্থনীতির চাকা ঘোরাতে যেমন ‘পুরোদমে’ অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড শুরু করা দরকার, ঠিক তেমনই ইগো ছেড়ে বিরোধী পক্ষের বিশেষজ্ঞদের মতামত গ্রহণ করাটাও বিশেষ জরুরি। সেটাই হবে সরকারের উচিত কাজ। লক্ষ্য ঠিক থাকলে যে অর্থসঙ্কটই আসুক না কেন ভারত নিশ্চয় অতীতের মতোই সেই ধাক্কা সামলাতে পারবে।