স্মরণকালের ভিতরে সবচেয়ে বড় বিপর্যয়ের কারণ করোনা সংক্রমণ। প্রথম দফার লকডাউন থেকে ধরলেও করনো বিপর্যয়ের পাঁচ মাস পেরিয়ে গিয়েছে। কিন্তু সংক্রমণ ব্যাপক আকার নেওয়ার ভীতিটা ভারতবাসীকে গ্রাস করেছিল তারও মাস খানেক আগে। সেই হিসেবে গত ছ’মাস যাবৎ গোটা দেশ ভালো নেই। সাধারণ মানুষের ভালো থাকা না-থাকা নির্ভর করে রুটিরুজির উপর। মানুষের প্রথম চাহিদা হল দু’বেলা পেট ভরার মতো খাবার। ভাত রুটি ডাল সব্জি মাছ ডিম মাংস দুধ প্রভৃতির ভিতরেই ভারতবাসী তার রুচি অনুযায়ী খাবার বেছে নেয়। অতএব পরিবারের সবার জন্য এসব সাধারণ খাবার জোগাড়ের মতো আয়ের সংস্থান থাকাটা জরুরি। তারপর ঘরভাড়া/ইএমআই, চিকিৎসা, শিক্ষা প্রভৃতির জন্যও নিয়মিত কিছু টাকার জোগান থাকা দরকার। এই যে ন্যূনতম চাহিদার কথা বলা হল, এই বাবদ যে টাকার প্রয়োজন তা জোগাড় করতে একটি সাধারণ চাকরি অথবা স্বাধীন কোনও পেশায় স্বাভাবিক আয় থাকা দরকার। করোনা পরিস্থিতির এই অর্ধ বছরে সাধারণ মানুষের প্রায় সব হিসেব উল্টেপাল্টে গিয়েছে। সারা ভারতে কয়েক কোটি মানুষের চাকরি চলে গিয়েছে। আবার যাঁরা চাকরিতে বহাল রয়েছেন তাঁদেরও একটা বড় অংশের মাইনে কমে গিয়েছে। ভারতের অর্থনীতির স্তম্ভ হল অসংগঠিত ক্ষেত্র। গৃহপরিচারক, রিকশচালক, নানা ধরনের হকার বা ফেরিওয়ালা, চাওয়ালা, ফুচকাওয়ালা, অফিসপাড়াগুলিতে খাবার বিক্রেতা, টাইপিস্ট, ল-ক্লার্ক-সহ নানা ধরনের সহকারী, হাটে-বাজারে অস্থায়ী স্টলে জামাকাপড় এবং নানা ধরনের পণ্যের পসারি, বিভিন্ন ধরনের শিল্পী, ছোটখাটো দোকানদার প্রভৃতি কয়েক কোটি মানুষকে নিয়ে এক বিরাট আর্থিক ক্ষেত্র। ১ জুন থেকে আনলক পর্বের শুরু। কিছুদিন পর দেশের নানা জায়গায় সীমিত পরিসরে বাস, ট্যাক্সিও চালু হয়েছে। বাজার দোকানের উপরেও শিথিল হয়েছে সরকারি নিয়ন্ত্রণ। তবু মানুষের মনের ভয় কাটেনি। সে অবশ্য অমূলক নয়। কারণ সংক্রমণ অব্যাহত এবং তার ঊর্ধ্বগতি। মৃত্যুর হার সারা পৃথিবীর মধ্যে বেশ কম এবং সুস্থতার হার যথেষ্ঠ আশাব্যঞ্জক হলেও এই ভয় কাটিয়ে ওঠা সহজ নিশ্চয় নয়। তার উপর এখনও পর্যন্ত বন্ধ লোকাল ট্রেন এবং মেট্রোরেলের চাকা। যদিও রেলের চাকা সচল করে তোলার জন্য জোর তৎপরতা শুরু হয়ে গিয়েছে। আলাপ-আলোচনা চলছে কেন্দ্র এবং রাজ্য স্তরে। চেষ্টা হচ্ছে একটি সমন্বয় গড়ে তোলার।
কিন্তু যতক্ষণ না পরিবহণ স্বাভাবিক হচ্ছে ততক্ষণ অর্থনীতিতে স্বাভাবিকতা ফিরে আসা সম্ভব নয়। সরকারি এবং বেসরকারি সমস্ত ক্ষেত্রকে নিয়ে অর্থনীতি। পরিবহণের স্বাভাবিকতার সঙ্গে যার সম্পর্কটি ওতপ্রোত। এই অস্বাভাবিক পরিস্থিতির প্রথম ও প্রধান বলির নাম অর্থনীতি। নুয়ে পড়ার অর্থনীতিতে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে গরিব এবং নিম্ন মধ্যবিত্ত শ্রেণী। গরিব নেমে গিয়েছে গরিবি রেখার নীচে। নিম্ন মধ্যবিত্ত নেমে এসেছে গরিবের স্তরে। একে হাতে টাকা-পয়সা ভীষণ কম কিংবা মোটে নেই, তার উপর চেপেছে স্বাস্থ্যবিধি রক্ষার খরচ। বেড়ে গিয়েছে যাতায়াত খরচ। আবার এই সময়েই বেড়ে চলেছে সমস্ত ধরনের জিনিসপত্রেরও দাম।
গরিবরা রেশন মারফত বিনামূল্যে চাল পেলেও সব্জি, ডাল, তেল, মাছ, ডিম, মাংস, ফল, দুধ প্রভৃতির দাম বড্ড বেড়ে গিয়েছে। বিশেষ করে আলুর দামটা একেবারেই লাগামছাড়া। আলুসেদ্ধ ভাত খেতে হলে অন্তত কিছু আলুর প্রয়োজন। আলুর দামের উপর নজরদারি শুরু করেছে প্রশাসন। এনফোর্সমেন্ট শাখার অফিসাররা বাজারে বাজারে হানাও দিচ্ছেন। তবুও দাম স্বাভাবিক হয়নি বলেই অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে। নজরদারিটাকে নিয়মরক্ষার ঊর্ধ্বে নিয়ে যেতে হবে, আরও আন্তরিক করে তুলতে হবে, যাতে সত্যিই কিছুটা কাজ হয়। প্রয়োজনে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আলোচনা করাও দরকার। মোদ্দা কথা, আলু-সহ সমস্ত নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম সাধারণ মানুষের সাধ্যের মধ্যে রাখতেই হবে। মানুষ এমনিতেই ভালো নেই—এটুকু করতে না পারলে মানুষের অবস্থা কিন্তু আরও খারাপ হয়ে যাবে।