ভারত একটি উন্নয়নশীল দেশ। মানে, দেশটি উন্নত দুনিয়ার সমগোত্রীয় নয়। সেই স্তরে উন্নীত হওয়ার লক্ষ্যে এগচ্ছে। গত চার দশক যাবৎ সেটাই শুনে আসছেন দেশবাসী। তবু, ভারত ‘উন্নত’ দেশের সংজ্ঞাভুক্ত এখনও হতে পারেনি। কবে তা সম্ভব হবে, সেই উত্তর অর্থনীতি এবং রাষ্ট্রনীতির কোনও পণ্ডিতের সম্ভবত জানা নেই। মাঝেমধ্যে আমরা পুলকিত হই আন্তর্জাতিক অর্থ ভাণ্ডার, বিশ্ব ব্যাঙ্ক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাঙ্ক প্রভৃতি মান্য সংস্থার কিছু ভবিষ্যৎবাণী শুনে। যেমন—পৃথিবীর সবচেয়ে দ্রুতগতির অর্থনীতিগুলির মধ্যে জায়গা করে নিয়েছে ভারত। অমুক সালের ভিতরে ভারতের আর্থিক বিকাশের হার চীনকে ছাপিয়ে যাবে! অমুক সালের মধ্যে ভারতের অর্থনীতি যুক্তরাষ্ট্রের স্তরে পৌঁছে যাবে! খবরের কাগজ ভাঁজ করে রেখে কিংবা টিভির পর্দা থেকে চোখ সরিয়ে নিয়ে গরিব মানুষ যখন বাজারের ব্যাগ হাতে নেয় তখন টের পাই যে সবকিছু রূপকথা নয়। বাস্তব বড়ই কঠিন, কঠোর। ভারত এখনও ভারতেই পড়ে রয়েছে। শখের জিনিস কেনাকাটা দূরে থাক, বেশিরভাগ মানুষ সাধারণ ডাল, ভাত/রুটি, সব্জির জোগাড় করতেও অক্ষম। নিজের ঘরের ব্যবস্থা করা যায়নি জীবনের শেষদিকে পৌঁছেও। অবসরের বয়সেও অবসর নেওয়া যাচ্ছে না। কাজ না করলে খাবেন কী? সে তো নিত্য অসুস্থ হওয়ার বয়স। তখনও চিকিৎসার সুযোগ মেলে না টাকারই অভাবে। ঘরে ঘরে অপুষ্টি আর অশিক্ষা টাকার অভাবে।
কারণ বেকারের সংখ্যা অগুনতি। কমছে না। বাড়ছে। কাজের সুযোগ বৃদ্ধির উপায় কৃষি, শিল্প, বাণিজ্য এবং পরিষেবা ক্ষেত্রের পরিধি বাড়ানো। সাড়ে তিন বছরের বেশি হল, নোটবন্দি আর ত্রুটিপূর্ণ জিএসটি ব্যবস্থা সেই সম্ভাবনার মূলে কুঠারাঘাত করেছিল। সবকিছুর বৃদ্ধি থমকে গিয়েছিল। একটা সময় পর শুরু হল অবনতি। ভারতের অর্থনীতির চাকা যখন পিছনে ঘুরছে অপ্রতিরোধ্য গতিতে, তখনই নেমে এল করোনার ধাক্কা। বাকিটা তো জীবন্ত ইতিহাস! কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া বেসরকারি ক্ষেত্রে নিয়োগ পুরো বন্ধ। বহু মানুষ পুরনো চাকরি হারিয়েছেন এবং এখনও হারাচ্ছেন। আবার চাকরি যাঁদের আছে তাঁদের সকলের বেতন অক্ষত নেই। মাসিক বেতন খানিকটা কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। স্বনিযুক্ত ক্ষেত্রও মুখ থুবড়ে রয়েছে। ওই ধরনের মানুষের হাতও শূন্যপ্রায়। সরকারি ক্ষেত্রে চাকরির নিশ্চয়তা আছে বটে, কিন্তু সব রাজ্যে ডিএ, ইনক্রিমেন্ট এবং অন্যান্য পাওনা সরকার দিতে পারছে না।
সেদিক থেকে ব্যতিক্রম পশ্চিমবঙ্গ। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাংলায় পরিযায়ী শ্রমিকদের বিরাট ধাক্কা রয়েছে। তার পরেও বেকারত্ব কমানোর বিচারে আমাদের রাজ্যের মুখ সারা দেশের মধ্যে উজ্জ্বল। বিকল্প কর্মসংস্থানের মানবিক উদ্যোগের সফল রূপায়ণের ফলেই প্রায় অসম্ভব এই কাজটি সম্ভব হয়েছে। সাধারণ মানুষের পাশে দাঁড়াচ্ছে যে প্রশাসন, তার সঙ্গে যুক্ত লক্ষ লক্ষ মানুষের এক দক্ষ কর্মী বাহিনী। করোনা যুদ্ধে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরাট ভরসা এই সরকারি কর্মীরা। তাঁরা আন্তরিকভাবে কাজ না করলে এই লড়াই চালিয়ে যাওয়া অসম্ভব হতো। স্বভাবতই তাঁদের ন্যায্য প্রাপ্য বেতন, ভাতা, ইনক্রিমেন্ট প্রভৃতি মিটিয়ে দেওয়া সরকারের নৈতিক দায়িত্ব। আর্থিক পরিস্থিতি সম্পূর্ণ বিরূপ। আমরা জানি, সরকারের রাজস্ব সংগ্রহ বৃদ্ধি এসময় অসম্ভব। বরং অনেকটাই কমে গিয়েছে। অন্যদিকে, খরচ বেড়েছে বিপুল হারে। তবুও রাজ্য সরকার কর্মীদের মুখ চেয়ে নিয়মিত বেতন দিচ্ছে। একইসঙ্গে প্রশংসনীয় পদক্ষেপ করেছে ইনক্রিমেন্টের প্রশ্নে। জুলাই মাসে ৩ শতাংশ হারে ইনক্রিমেন্ট বহাল রেখেছে। পঞ্চায়েত, পুরসভা, স্বশাসিত সংস্থা এবং সরকারের আর্থিক অনুদান নির্ভর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত সকলেই এই সুবিধার আওতায় রয়েছেন। উপকৃতের সংখ্যা সব মিলিয়ে প্রায় সাড়ে সাত লক্ষ। যাতায়াত খরচ বেড়েছে। নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দামও ঊর্ধ্বমুখী। এই পরিস্থিতিতে সরকারি কর্মীদের ইনক্রিমেন্ট দেওয়ার সিদ্ধান্ত সুবিবেচনারই পরিচয়। করোনার বিরুদ্ধে যুদ্ধটা আরও ভালোভাবে চালানোর পক্ষেই সহায়ক হবে এই পদক্ষেপ।