রাজনীতির প্রাচীন সংজ্ঞা চারটি বিষয় বা নীতির উপর প্রতিষ্ঠিত। সাম, দান, ভেদ ও দণ্ড। ‘সাম’ শব্দের অর্থ শত্রুকে বশীভূত করা। তোষণ এবং সন্ধিস্থাপনের মাধ্যমে তা সম্ভব। দ্বিতীয় উপায় হল স্বত্ব ত্যাগ বা দান করা। পাশা কিংবা কূটনীতির খেলায় বিপক্ষকে যে চাল দেওয়া হয় সেটাকেও ‘দান’ বলে। ‘ভেদ’ মানে ভেদাভেদ করা। বিভেদনীতি। সর্বশেষ হল দণ্ডনীতি। শাসকের বিচারে যে অপরাধী সে শাস্তি পাবে। রাজনীতি তাই একইসঙ্গে রাজার নীতি এবং নীতিরও রাজা বটে। গণতান্ত্রিক দেশে রাজার অস্তিত্ব নেই। বিশেষত ভারতের মতো যেসব দেশ বহুদলীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় পরিচালিত, সেখানে নির্বাচিত সরকারের প্রধানই হলেন শাসক। তিনি রাজার বিকল্প।
রাজতন্ত্র বেশিরভাগ দেশে অতীত অধ্যায় হয়ে গেলেও দেশশাসনের মূল নীতি, মূল সুর বিশেষ পাল্টায়নি। শাসন ক্ষমতা দখলের জন্য দলগুলি চেনা রাজনৈতিক উপায়গুলিই অনুসরণ করে। ক্ষমতা দখলের পর চলে তা ধরে রাখার নতুন লড়াই। নির্বাচিত সরকার একটি নির্দিষ্ট মেয়াদের জন্য শাসন করার অধিকার পায়। তার পরেও থাকতে হলে তাকে ফের ভোটে জিতে ফিরতে হয়। জিতে ফেরার একটিই রাস্তা—মানুষের মন জয় করা। মানুষের মন জয় করার একটিই রাস্তা—কাজ করা। এমনভাবে কাজ করতে হয় যেন মানুষ সরকারের দিকে অভিযোগের তর্জনী তুলতে না পারে। সুশাসন নিশ্চিত করার ব্যাপারে সরকারের চূড়ান্ত লক্ষ্য থাকা দরকার। সাধারণভাবে সুশাসন কখন বলা হবে? সুনাগরিকের সমস্ত প্রাপ্য অধিকার সুরক্ষিত রয়েছে। প্রতিশ্রুতিমতো উন্নয়ন হচ্ছে। দুর্বলকে রক্ষা করার জন্য সরকার আন্তরিকভাবে চেষ্টা করছে। দরিদ্র এবং দুর্বলকে উপরের স্তরে টেনে তোলা হচ্ছে। এ হল আদর্শ পরিস্থিতি। কিন্তু, সরকারের প্রধান অত্যন্ত নীতিনিষ্ঠ এবং মানবিক হলেও এই আদর্শ পরিস্থিতি ধরে রাখা কঠিন। কারণ, দল এবং প্রশাসনের সঙ্গে যুক্ত অসংখ্য মানুষকে নিয়েই যে সরকারকে একটি করে টার্ম পেরতে হয়। কে না জানে, সব মানুষ সমান হয় না। চেনা মানুষেরও চরিত্র বদলে যায়। কোনও কোনও পরিস্থিতিতে ভালো মানুষ খারাপ হয়ে যায়। সাধু থেকে শয়তানে রূপান্তরের নজির ভূরি ভূরি। তাই দুর্বৃত্তদের দমনের জন্য সুশাসকের প্রশাসনকে সদা সতর্ক থাকতে হয়। খারাপ লোকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে ভালো সরকার কখনওই রং বিচার করে না। ‘আমার লোক’, ‘ওদের লোক’ প্রভৃতি ভেদাভেদ করে না।
বিষয়টি পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের পরিপ্রেক্ষিতেও ভেবে দেখা যায়। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে ভারতের সবচেয়ে মানবিক মুখ্যমন্ত্রী বললে অত্যুক্তি হবে না। তাঁর বিরোধীদেরও অনেকে একান্তে একথা স্বীকার করেন। শাসনভার নেওয়ার আগে প্রায় তিন দশক তিনিই ছিলেন জনপ্রিয়তম বিরোধী নেত্রী। তাঁর জনপ্রিয়তার চাবিকাঠি ছিল—মানুষের জন্য, মানুষকে সঙ্গে নিয়ে রাজনীতি করা। জনস্বার্থ-বিরোধী যে-কোনও বিষয়ের প্রতিবাদে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিকল্প কাউকে বাংলা পায়নি। গরিব মানুষের অধিকার রক্ষার জন্য তিনি একের পর এক আন্দোলন করেছেন। নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়েও। করোনা মহামারীর গ্রাস থেকে বাংলাকে বাঁচানোর জন্য তিনি যখন সামনে থেকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন, ঠিক তখনই মহানগরী কলকাতা এবং কয়েকটি জেলা বিধ্বস্ত হয়ে গেল ঘূর্ণিঝড়ে। কেন্দ্রের চিরাচরিত অসহযোগিতার ভিতরেও তাঁর সরকার চালিয়ে যাচ্ছে ত্রাণবিলির কাজ। আর এই কাজেই বেশকিছু ত্রুটি—স্বজনপোষণ, চুরি, দুর্নীতি চিহ্নিত হয়েছে। নজরে আসামাত্রই দুর্বৃত্তদের বিরুদ্ধে খড়্গহস্ত মুখ্যমন্ত্রী। দলের যেসব লোক গরিবের প্রাপ্য আত্মসাৎ করেছে, সেসব ফেরত দিতে বাধ্য করেছেন তিনি। কিছু নেতাকে পদ থেকে সরানো হয়েছে। কিছু জনপ্রতিনিধিকে বহিষ্কারও করেছে দল। একইসঙ্গে দলীয় নেতৃত্বের প্রতি তাঁর নির্দেশ, কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য অভিযুক্তদের ওজন বিচার নিষ্প্রয়োজন। বাংলার রাজনীতিতে এই ঘটনা শুধু প্রশংসনীয় নয়, অভূতপূর্বও বটে। সব দলের উচিত, দল পরিচালনায় এই নিরপেক্ষতার নীতি অনুসরণ করা। তবেই রাজনীতি সঙ্কীর্ণতার কানাগলি ছেড়ে যথার্থই মানুষের রাজনীতি হয়ে উঠবে।