সেই কবে কোলে কাঁখে বাচ্চা আর বাক্স প্যাটরা নিয়ে সীমান্ত পেরিয়ে এপারে ঠাঁই নিয়েছিলেন তাঁরা। মানে আজকের উদ্বাস্তু কলোনির বাসিন্দাদের পূর্বপুরুষরা। তারপর গঙ্গা-পদ্মা দিয়ে অনেক জল গড়িয়ে গিয়েছে, এখন তাঁরা বাংলার বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে আছেন। এইভাবেই কয়েক লক্ষ উদ্বাস্তু পরিবার গত পাঁচ দশকের বেশি সময় সরকারি বেসরকারি জমি দখল করে মাথা গোঁজার ঠাঁই করে নিয়েছেন। পোশাকি ভাষায়, এঁদের অনেকেই কলোনির বাসিন্দা। কিন্তু সেই কলোনিতেই কয়েক দশক কাটিয়ে দিলেও পরিযায়ী হয়ে জীবন কাটছিল। মাথার উপর ছাদ থাকলেও তার অধিকার নেই। তাঁদের এই দীর্ঘ যন্ত্রণা থেকে মুক্তি দিয়ে অধিকার পাইয়ে দিতে তিনি যেন কল্পতরু হয়ে উঠলেন। ক্ষমতায় এসে রাজ্যের ৯৪টি কলোনির বাসিন্দাদের হাতে সত্ত্বাধিকার দলিল তুলে দিয়েছিলেন। দ্বিতীয় পর্যায়ে আরও ১১৯টি কলোনির বাসিন্দাদের স্বপ্নপূরণের দলিল দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, যা তাঁর মানবিকতারই দৃষ্টান্ত।
সবকিছুই ঠিকঠাক চলছিল। কিন্তু ঘরপোড়া গরু সিঁদুরে মেঘ দেখলেই ভয় পায়। সেই আশঙ্কার মেঘই ঘনীভূত হচ্ছে উদ্বাস্তু ওই মানুষগুলির মনে। সামনের বছরেই রাজ্যে বিধানসভা ভোট। অনেকেরই রেশন কার্ড, ভোটার কার্ড এমনকী আধার কার্ড থাকলেও কেন্দ্রের তৈরি এক আইনের খোঁচায় মানুষগুলির বড় অসহায় অবস্থা। বাংলা তাঁদের বড় ভরসার জায়গা হলেও কী দিয়ে প্রমাণ করবেন যে তাঁরা এদেশেরই নাগরিক? দেশের একের পর এক সরকার অনুপ্রবেশ আটকাতে ব্যর্থ হয়েছে। তার দায় তো তাঁদের নয়। বছরের পর বছর যাঁরা এদেশে রয়েছেন বলির পাঁঠা করার চেষ্টা হচ্ছে তাঁদেরকে। সে জন্যই দেশের শাসক এমন এক আইনকে অস্ত্র হিসেবে বেছে নিয়েছে যা কপালে চিন্তার ভাঁজ ফেলার পক্ষে যথেষ্ট। সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন (সিএএ) এখন বহু মানুষেরই মাথাব্যথার কারণ। করোনা আবহের মধ্যেও দেশের শাসক যে ওই আইন কার্যকর করার ব্যাপারে লক্ষ্যচ্যুত হয়নি তা ডিজিটাল সভা থেকে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর অমিত শাহের বক্তব্যেই স্পষ্ট। বিপদের সময়েও যেভাবে তিনি সিএএ বিতর্ককে উস্কে দিয়েছেন তা অমানবিকতারই নিদর্শন। বেশ বোঝা যাচ্ছে বাংলার ভোটে সিএএ প্রসঙ্গকেই নির্বাচনী অস্ত্র করতে চলেছে গেরুয়া শিবির। তাই উদ্বাস্তু মানুষগুলির সেই বিপদের আঁচ করেই তাঁদের নাগরিকত্বের স্বীকৃতিকে আরও মজবুত করতে স্থায়ী ঠিকানা দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছে মা মাটি মানুষের সরকার। এতে লক্ষাধিক উদ্বাস্তু উপকৃত হবেন। দলিলটি হাতে থাকলে নাগরিকত্ব প্রমাণে অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। এই কারণেই প্রায় তিন লক্ষ উদ্বাস্তু পরিবারকে নাগরিকত্বের সমস্ত অধিকার ও সুযোগ সুবিধা দেওয়ার লক্ষ্য নিয়ে এগচ্ছেন মমতা। এর প্রয়োজনীয়তাকে অস্বীকার করার উপায় নেই। এভাবেই তিনি ওই মানুষগুলির কাছে পাশে থাকার বার্তাটিও পৌঁছে দিলেন, যা হয়তো বিধানসভা ভোটে তাঁকে মাইলেজ দেবে।
উল্টোদিকে, বারবারই দেখা গেছে কেন্দ্রের বিজেপি সরকারের কেষ্টবিষ্টুদের ভোট এলেই তৎপরতা বাড়ে। পরিযায়ী পাখিদের মতো বাংলায় আনাগোনা হয়। নানা ক্ষেত্রে নিজেদের ব্যর্থতা ঢাকতে এমন সব বিষয় তাঁরা সামনে আনেন যাতে সাধারণ মানুষ ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়ে। প্রকৃত সমস্যাগুলি আড়ালে থেকে যায়। করোনা আবহের মধ্যেও সিএএ বিতর্ক এমনই একটা বিষয়। বেহাল অর্থনীতি, ভয়াবহ বেকার সমস্যা, কৃষি ও কৃষিপণ্য বিপণনেও কর্পোরেটদের দরজা খুলে দেওয়া, রাষ্ট্রায়ত্ত নানা ক্ষেত্রে বেসরকারিকরণ, শ্রম আইনে বদল ইত্যাদির কারণে উদ্ভুত সমস্যা থেকে দৃষ্টি ঘোরানোর কৌশল নিয়েছে দেশের শাসক দল। তাই বিপদের মধ্যেও ভোট বৈতরণী পারের উদ্দেশে হাতিয়ার করতে চলেছে সিএএকে, যাতে নাগরিকত্ব প্রমাণের কাগজপত্র জোগাড় করতেই ব্যস্ত হয়ে পড়েন সাধারণ মানুষ। মূল সমস্যা থেকে অভিমুখ ঘোরানোর এই প্রচেষ্টায় উদ্দেশ্যসিদ্ধি কতটা হবে তা জানা নেই। তবে এই মুহূর্তে উদ্বাস্তু কলোনির বাসিন্দাদের নিঃশর্ত দলিল দেওয়ার সিদ্ধান্ত কার্যকর করার কথা জানিয়ে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যে মাস্টার স্ট্রোকটি দিলেন তাতে তারা নিঃসন্দেহে কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখেই পড়ল। আনলক পর্ব থেকেই রাজ্যের উদ্বাস্তুদের পাশে দাঁড়িয়ে তাঁদের স্বীকৃতি দিতে যুদ্ধকালীন তৎপরতায় প্রয়োজনীয় কাজ শুরু করেছে রাজ্য। উচ্ছেদ করার বদলে উদ্বাস্তুদের মাথা গোঁজার জন্য স্থায়ী ঠিকানা দেওয়ার ব্যবস্থা মমতার সংবেদনশীল মানসিকতারই বহিঃপ্রকাশ। এটাই হয়তো একদিন তাঁদের কাছে নাগরিকত্ব প্রমাণের রক্ষাকবচ হয়ে দাঁড়াবে। যার ইতিবাচক প্রভাব ভোটে পড়লে অবাক হওয়ার নয়। তড়িঘড়ি কলোনির বাসিন্দাদের জন্য এই রক্ষাকবচ দেওয়ার উদ্যোগ নিয়ে রাজনৈতিক দূরদর্শিতার পরিচয়ই রাখলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, যা তাঁকে নির্বাচনী প্রতিদ্বন্দ্বিতায় কয়েক কদম এগিয়েই রাখল।