কোনও আগ্নেয়াস্ত্রের ঝঙ্কার নয়, বিমান থেকে গোলাবর্ষণও নয়। স্রেফ লোহার রড, পেরেক লাগানো লাঠি আর পাথর ছিল অস্ত্র। তা দিয়েই ভারতের অন্তত ২০ জন সেনাকে খতম করে দিল চীনের সেনাবাহিনী। ভারতের প্রত্যাঘাতে চীনের ক্ষয়ক্ষতি অবশ্য বেশি। শান্তিপ্রিয় ভারতের পড়শি রাষ্ট্র চীনের আগ্রাসন নীতি মনে করিয়ে দিল ৪৫ বছর আগের অতীতকে। তখন ভারতের অরুণাচলপ্রদেশের এক ভূখণ্ডে লালফৌজের হানায় প্রাণ গিয়েছিল চার ভারতীয় সেনার। সোমবার রাতে ঘটল লাদাখের গালওয়ান উপত্যকার এই ঘটনা। গোটা বিশ্ব যখন করোনার আতঙ্কে জুজু হয়ে রয়েছে তখন ভারত-চীন সীমান্তে এই সংঘর্ষের ঘটনা আন্তর্জাতিক মহলে সাড়া ফেলে দিয়েছে। প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখা লঙ্ঘন করে যেভাবে আগ্রাসী হয়েছে চীনা সেনা তাতে পরিস্থিতি অগ্নিগর্ভ হয়েছে। বলা যায়, ভারতের সঙ্গে বারবার বিশ্বাসঘাতকতা করে চলেছে চীন। জওহরলাল নেহরুর সময় থেকেই তারা বিশ্বাসভঙ্গের নজির রেখেছে যা নিন্দনীয়। ভারত-চীন ভাই ভাই—বন্ধুত্বের এই নীতির বদলে তারা চুক্তিভঙ্গ করছে, যার যোগ্য জবাব নিশ্চয়ই তারা পাবে। উল্টোদিকে ভারত শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানেই বিশ্বাসী। প্রথমবার ক্ষমতায় আসার পর প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে চীনের প্রেসিডেন্টের সঙ্গে দোলনায় দুলেছিলেন, এমনকী ২০১৮ সালেও কূটনৈতিক আড্ডাতে মেতেছিলেন। কিন্তু সেসবের মূল্য দিতে চীন যে নারাজ তা তাদের আগ্রাসী মনোভাবেই স্পষ্ট। রয়েছে সৌজন্যের অভাব। ভারত কিন্তু দুর্বল কোনও দেশ নয়। নিজেদের ভূখণ্ডে সার্বভৌমিত্ব রক্ষা করতে ভারত বদ্ধপরিকর। তাই চীনকে পাল্টা জবাব দিতে সময় না নিয়েই প্রত্যাঘাত করেছে। ভারতীয় সেনার দক্ষতা তো প্রশ্নাতীত। লাদাখের দারবুক থেকে দৌলতবেগ ওন্ডি বায়ুসেনা ঘাঁটি পর্যন্ত প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখার সমান্তরাল যে রাস্তা ভারত তৈরি করেছে তাতেই নাকি আপত্তি চীনের। কিন্তু তাদের আপত্তি ধোপে টেকেনি, আসলে সবটাই চীনের অজুহাত মাত্র।
অন্যের ভূখণ্ডে অনুপ্রবেশ করে দাদাগিরি করার প্রবণতা চীন ছাড়ছে না। ভারতের ভূখণ্ড দখল করার আগ্রাসী মনোভাব তাদের নতুন কোনও কৌশল নয়। ১৯৬২ থেকে ’৭৫ পর্যন্ত বারবার তারা অশান্তির আবহ তৈরি করেছে এবং প্রত্যেকবারই প্রতিরোধ করেছে ভারত। গত মে মাসেই লাদাখ সীমান্তে ঘাঁটি গেঁড়ে বসেছিল চীনা সেনা। আসলে চীন ‘ফাইভ ফিঙ্গার পলিসি’ কার্যকর করতে মরিয়া। তাদের ঘোষিত নীতিই হল অরুণাচলপ্রদেশ, লাদাখ, সিকিম, ভুটান ও নেপালের ভূখণ্ড দখল করা। সেই লক্ষ্যেই
কখনও ডোকালাম, কখনও লাদাখে উত্তেজনা তৈরি করেছে। কিন্তু সফল হচ্ছে না। অবশ্য লাদাখে চীনের আগ্রাসনের পিছনে অন্য কারণও আছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
এই মুহূর্তে আন্তজার্তিক ক্ষেত্রে চীন অনেকটাই কোণঠাসা। করোনার কারণে আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়াসহ বিভিন্ন দেশ চীনের বিরুদ্ধে মুখ খুলেছে। একসময় ভারতের বাজার সস্তার চীনা পণ্যে ছেয়ে গিয়েছিল। সেই
বাজার এখন না থাকায় আর্থিক দিক থেকেও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে তারা। পাশাপাশি অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রেও বেকায়দায় পড়েছে। ডোকালাম থেকে সেনা সরানো এবং বেকারত্ব বেড়ে যাওয়ার কারণে নিজের দেশেই সমালোচিত হচ্ছে শি জিনপিংয়ের সরকার। এই অবস্থায় নিজেদের অস্তিত্বকে প্রবলভাবে জানান দিতে ভারতীয় ভূখণ্ডে উত্তেজনা ছড়ানোর চেষ্টা করছে প্রবল শক্তিধর এই দেশটি।
এ কাজে শুধু নিজেরা একা নয়, কাশ্মীর ইস্যুতে পাকিস্তানকে উস্কে দিয়ে, উত্তরাখণ্ডের জমি দখলে নেপালকে মদত দিয়ে চীন আসলে ভারতকে ধারাবাহিকভাবে চাপে রাখার কৌশল নিয়েছে। ব্যর্থও হচ্ছে। শক্তিধর ভারত এই কৌশল সফল হতে দেবে না। কারণ ১৯৬২ সালের পরিস্থিতি এখন আর নেই। লাদাখের পার্বত্য এলাকায় ভারতের সামরিক শক্তিও এখন চীনের থেকে অনেক বেশি। তাই মার দিলে পাল্টা মার খেতেই হবে
জিনপিং-এর সেনাবাহিনীকে। এছাড়া আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রেও চীন এখন যথেষ্ট চাপে। এই সত্যটি বুঝে তাদের আগ্রাসী এই মনোভাব অবিলম্বে ত্যাগ করাই বাঞ্ছনীয়। ভারত অবশ্য কোনওসময়েই যুদ্ধ চায় না, বরাবরই শান্তিরক্ষায় বিশ্বাসী। তাই আলাপ আলোচনার মাধ্যমেই সীমান্তের
পরিস্থিতি শান্ত করতে চায়। তার মানে এই নয়, পাল্টা আঘাত হানতে জানে না। তাই সীমান্তের পরিস্থিতির উপর নজর রাখছে। কেন্দ্র স্থির করেছে, এদেশের সেনা আর পিছনে সরবে না, লালফৌজকেই সম্পূর্ণ পিছু হটতে হবে। এটা সঠিক সিদ্ধান্ত।
যুদ্ধ কখনওই কাম্য নয়। তবে চীন যেভাবে চুক্তিভঙ্গ করে চলেছে
তার প্রতিবাদে গর্জে ওঠার বোধহয় সময় এসেছে। বিদেশি সেনা দেশের ভূখণ্ড দখল করে বসে থাকবে আর দেশ হাত গুটিয়ে বসে থাকবে তা তো হতে পারে না।