প্রাকৃতিক বিপর্যয় পশ্চিমবঙ্গের ফি বছরের সঙ্গী। কোনও বছর বন্যা, তো পরের বছর বিধ্বংসী ঝড়। কোনও বছর খরা, তো পরের বছর পাহাড়ে ধস। এছাড়া নদীতে ব্যাপক ভাঙন, সুন্দরবন অঞ্চলে মাইলের পর মাইল নদীবাঁধ ভেঙে যাওয়া, লোনাজল ঢুকে গিয়ে কৃষিজমি নষ্ট হয়ে যাওয়ার মতো সমস্যাগুলি আছেই। এবারের করোনা বিপর্যের মতো রোগ সংক্রমণের বিপদ স্মরণকালের ভিতরে হয়নি ঠিকই, তবে ‘অজানা’ জ্বর, ম্যালেরিয়া, এনসেফেলাইটিস, চিকনগুনিয়া, ডেঙ্গু প্রভৃতিও কম ভোগায় না এরাজ্যকে। বার্ড ফ্লুর আক্রমণে ব্যাপক হারে মুরগির মৃত্যু, আচমকা রোগপোকার প্রকোপ বৃদ্ধি কিংবা শিলাবৃষ্টির কারণে ফসলের বিপুল ক্ষতি নতুন নয়। দেশভাগের কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতির শিকার ভারতের যে রাজ্যটি, তার নাম পশ্চিমবঙ্গ। একাত্তরের যুদ্ধের সময় থেকেও এপার বাংলাকে বিপুল শরণার্থীর চাপ স্বীকার করতে হয়েছে। আমরা জানি। আমরা আরও জানি, উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসনের জন্য বাংলাকে যতটা আর্থিক সাহায্য দেওয়ার প্রয়োজন ছিল, কেন্দ্রীয় সরকার তা কোনও দিন দেয়নি। যে আন্তরিকতা নিয়ে বাংলার পাশে এখনও দাঁড়ানো উচিত, কেন্দ্রীয় শাসকদের সেই অভাবটাই এক স্বাভাবিক প্রবণতা।
২৬ মে, ২০১৪ নরেন্দ্র মোদি দেশের দায়িত্ব নিয়েছিলেন এই প্রত্যাশা জাগিয়ে যে, দেশ-শাসনের অবাঞ্ছিত ট্র্যাডিশন তিনি ভাঙবেন। প্রথম দফায় প্রত্যাশাপূরণে ব্যর্থ হলেন তিনি। তবুও বিপুল ভোটে জিতিয়ে মানুষ ২৯ মে, ২০১৯ তাকে ফের ক্ষমতাসীন করল। ডিমানিটাইজেশন থেকে ত্রুটিপূর্ণ জিএসটি বলবৎ সহ গুচ্ছ গুচ্ছ ভুল সিদ্ধান্তের কারণে সরকারের বিরুদ্ধে সমালোচনার ঝড় ছিল। তবুও মানুষ মোদিজিকে ক্ষমতায় ফিরিয়েছে আরও একটি সুযোগ দিতে। প্রত্যাশা এই যে, দ্বিতীয় মোদি সরকার নিশ্চয় তাঁর সরকার শুধরে যাবে এবং মানুষের প্রতি দায়বদ্ধতা পালনে আন্তরিক ও যত্নবান হবে। কিন্তু অন্তত পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রে সেই দৃষ্টান্ত কিন্তু এখনও পর্যন্ত বিরল। আইলা থেকে ফণী, বুলবুল প্রতিটি টর্নেডোর পরেই আমরা দেখেছি—রাজ্য যথাসময়ে দাবি জানানো সত্ত্বেও কেন্দ্র টাকা এবং অন্যান্য সাহায্য পাঠাতে গড়িমসি করেছে। ক্ষয়ক্ষতির যে হিসেব রাজ্য দেয়, কেন্দ্র তা মানে না—দু’'টি হিসেবের মধ্যে তফাত কখনও কখনও যেন আশমান-জমিন! আর এ নিয়ে যে রাজনৈতিক তরজা জমে ওঠে, তা অনেক সময়ই সৌজন্যের সীমারেখা অতিক্রম করে যায়।
ভয়ঙ্কর করোনা পরিস্থিতির ভিতরে ২১ মে, বৃহস্পতিবার বাংলা নতুন করে মহাবিপদে পড়ে গেল। উম-পুন ঝড়ে বিধ্বস্ত হয়ে গিয়েছে কলকাতাসহ দক্ষিণবঙ্গের অনেকখানি অঞ্চল। তাণ্ডবের তীব্রতা এমনই যে, দু’দিন কেটে যাওয়ার পরেও বিদ্যুৎ, পানীয় জলের সরবরাহটুকুও সব জায়গায় স্বাভাবিক হয়নি। আর ঘরবাড়ি, রাস্তাঘাট, ফোন, ইন্টারনেটের সমস্যা তো আছেই। উম-পুনের বিপদকে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যথার্থই বলেছেন, করোনার বিপদের থেকেও বড়। মুখ্যমন্ত্রীর ডাকে সাড়া দিয়ে প্রধানমন্ত্রী দ্রুত বাংলায় এসে শুক্রবার ক্ষয়ক্ষতির বহর স্বচক্ষে দেখে গেলেন। রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দও মানুষের এই দুর্দশায় নিজেকে পীড়িত বোধ করেছেন। দেশের প্রধান দুই নাগরিকই জানিয়েছেন, সারা দেশ বাংলার পাশে আছে। এজন্য তাঁদের ধন্যবাদ। প্রধানমন্ত্রী তাৎক্ষণিকভাবে ১ হাজার কোটি টাকার সাহায্য ঘোষণা করে গিয়েছেন। জানিয়েছেন, খুব শিগগির কেন্দ্রীয় টিম এসে বিস্তারিত সমীক্ষা করবে। এই হাজার কোটি টাকা পাঠাতে কেন্দ্র যেন মুহূর্তকালও বিলম্ব না করে। ব্যাপারটি চিকিৎসার মতোই—বিলম্বে ক্ষতের বৃদ্ধিই হয়। প্রসঙ্গত, প্রধানমন্ত্রীর আর্থিক ঘোষণা প্রয়োজনের সামান্য এক ভগ্নাংশমাত্র। অনুমান করা যায়, প্রধানমন্ত্রীর উপলব্ধিতেও তা আছে। মুখ্যমন্ত্রীর মতে, ক্ষতির আর্থিক পরিমাণ অন্তত এক লক্ষ কোটি টাকা। অতএব সমীক্ষা রিপোর্টের নামে কেন্দ্রীয় টিম যেন দৃষ্টিকটু দর কষাকষির পুরনো পথেই ফিরে না যায়। কেন্দ্র-রাজ্যের সম্পর্কটি তো অবিশ্বাসের নয়, সমন্বয়ের। সমন্বয় ছাড়া ভারত রাষ্ট্রের অগ্রগতি অসম্ভব। বাংলার সকলে চায়, কেন্দ্রীয় রিপোর্টে মুখ্যমন্ত্রীর দাবিরই সঙ্গত প্রতিফলন। মুখ্যমন্ত্রী তৎপর। এবার প্রধানমন্ত্রী আন্তরিক হলেই এই বিপদ দ্রুত কাটিয়ে উঠবে বাংলা।