বেশি ঔদ্ধত্য দেখিও না—বিজেপিকে নিশানা করে সতর্কবার্তা দিয়েছে শরিকদল শিবসেনা। দলের মুখপত্র ‘সামনা’য় মহারাষ্ট্রের ফল থেকে বিজেপি শীর্ষ নেতৃত্বের শিক্ষা নেওয়া উচিত বলেও বিজেপির কড়া সমালোচনা করেছে শিবসেনা। বলেছে, শুধুমাত্র ভোট মেশিনারি আর বিরোধীদের ভাগাভাগি করে যে ভোটে ভালো ফল করা যায় না,  এই ফল সেটা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে। রীতিমতো খোঁচা দিয়ে শিবসেনা বলেছে, মহারাষ্ট্রে কোনও রকমে মুখরক্ষা হয়েছে। ২০০ আসন দূরে থাক, মহারাষ্ট্রে এবার এককভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠতাও পায়নি বিজেপি। অথচ, মহারাষ্ট্রে এনডিএ-র টার্গেট ছিল ২২০-র বেশি আসন। লক্ষ করুন, ২০১৪ সালের বিধানসভা নির্বাচনে ভোট পূর্ববর্তী জোট হয়নি বিজেপি-শিবসেনার। তা সত্ত্বেও ১২২টি আসন জিতেছিল বিজেপি। শিবসেনার ঝুলিতে এসেছিল ৬৩ আসন। এবার ভোট-পূর্ববর্তী জোট করে লড়েছে দুই দল। কিন্তু তারপরেও দু’দলেরই আসন কমেছে। বিজেপি জিতেছে ১০৫টি আসন। শিবসেনার জয় পেয়েছে ৫৬টি আসনে। আর ছোট ছোট দল ও নির্দলদের ঝুলিতে গিয়েছে ২৫টি আসন। এই খারাপ ফলের জন্য বিজেপি নেতৃত্বের  ‘ক্ষমতার দম্ভ’কে দায়ী করে তোপ দেগেছে শরিক শিবসেনা। লোকসভা ভোটে এই রাজ্যের ২৮৮টি বিধানসভা আসনের মধ্যে বিজেপি এগিয়েছিল ১২৫টি আসনে,  এবং শিবসেনা এগিয়েছিল ১০৫টি আসনে। শিবসেনার পতন ছাড়াও বিজেপি নিজে খারাপ ফল করেছে মুখ্যমন্ত্রী দেবেন্দ্র ফড়নবিশ নিজের এলাকা বিদর্ভে। পশ্চিম মহারাষ্ট্রের অবস্থাও তথৈবচ।
বিজেপি ৩০৩টি লোকসভা আসন পাওয়ার পর ৩৭০ নিয়ে যে উচ্চগ্রামে তার বেঁধে নিয়েছিল এবং সারা দেশে এনআরসি চালু করে সমস্ত অবৈধ বিদেশিদের তাড়ানোর ডাক দিয়েছিল,  তা মহারাষ্ট্র, হরিয়ানা দুই রাজ্যেই পরাভবের সুরে পরিণত হয়েছে। বিজেপি ধরেই নিয়েছিলেন,  লোকসভা ভোটের ফর্মুলা দিয়ে কেল্লা ফতে করা যাবে। বেকারি,  কৃষি সঙ্কট,  বেহাল অর্থনীতির থেকে আম জনতার মুখ ঘোরাতে দেশভক্তিই যথেষ্ট। এই দুই রাজ্যের ভোটের ফল বিজেপির কাছে একটি বার্তা দিয়ে গেল যে জাতীয় ক্ষেত্রে নির্বাচন এবং রাজ্যের নির্বাচনের মধ্যে ফারাক রয়েছে। এবং, জাতীয় ইস্যু সব সময়ে স্থানীয় ইস্যুকে ছাপিয়ে যেতে পারে না। একইসঙ্গে জাতিভিত্তিক রাজনীতিতে নিজেদের দুর্গ দখলে রাখার জন্য স্থানীয় নেতাদের উপর ভর করার কৌশল কতটা কার্যকরী, সে ব্যাপারে প্রশ্ন তুলে দিয়েছে এই ফল। ফলে দুই রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীদের নিজের এলাকায় জমি হারিয়েছেন। বিদর্ভে দেবেন্দ্র ফড়নবিশ এবং উত্তর হরিয়ানায় মনোহরলাল খট্টর মাথা তুলে দাঁড়াতে পারেননি। সম্প্রতিক লোকসভা নির্বাচনে হরিয়ানার জাঠ অধ্যুষিত দশটি লোকসভা আসনে বিজেপি জয়ী হওয়া সত্ত্বেও বিধানসভা নির্বাচনে নয়টি বিধানসভা কেন্দ্রেই পরাজয় ঘটেছে পদ্ম শিবিরের। জাঠদের ক্ষেত্রে বিজেপির নেতিবাচক মনোভাবই জাঠ অধ্যুষিত এলাকায় বিজেপির ব্যর্থতার কারণ বলে মনে করছে একাংশের রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা। হরিয়ানায় নির্বাচন-পূর্ববর্তী সময়ে জাঠ সংরক্ষিত আসন বিতর্কে প্রাণ হারিয়েছিলেন ৪০জন। আপাতদৃষ্টিতে এই বিচ্ছিন্ন ঘটনার জেরেই জাঠ রাজ্যে জোর ধাক্কা খেল গেরুয়া রথ,  এমনটাই মনে করছে ওয়াকিবহাল মহল। গত লোকসভা ভোটে হরিয়ানার ৯০টি বিধানসভা আসনের মধ্যে ৭৯টিতে এগিয়েছিল বিজেপি। সেই সংখ্যাটা মাত্র পাঁচমাসের মধ্যে ৪০-এ নেমে এসেছে। সরকার গড়তে শেষ পর্যন্ত দুষ্যন্ত চৌতালার জেজেপির হাত ধরতে হয়েছে। মাত্র ১০টি আসন নিয়ে নির্ণায়ক ভূমিকায় পৌঁছে গিয়েছে জেজেপি। জোট করে সরকার গড়লেও প্রতিপক্ষ কংগ্রেসের  ‘অস্বস্তিকর’  অস্তিত্ব হাড়েহাড়ে টের পেতে হয়েছে পদ্মশিবিরকে।
দল বদলের খেলায়ও বিজেপি দুই রাজ্যে ধরাশায়ী। মহারাষ্ট্রে কংগ্রেস-এনসিপি ছেড়ে বিজেপি বা শিবসেনায় যোগ দিয়ে ভোটে নামা ৩৫ জনের মধ্যে অন্তত ১৯ জন হেরে গিয়েছেন। হরিয়ানাতে সব থেকে বেশি দল বদল ঘটেছিল আইএনএলডি থেকে। এই দলের অধিকাংশ বিধায়ক বিজেপিতে যান। তাঁদের প্রার্থী করতে গিয়ে হরিয়ানার ১২ জন বিধায়ককে টিকিট দেয়নি বিজেপি। কিন্তু দল-বদলে আসা এই নেতাদের অধিকাংশই হেরেছেন। অথচ, ২১ অক্টোবরের ভোট উপলক্ষে মোদি দুই রাজ্যে মোট ১৬টি সমাবেশ করেছেন,  অমিত শাহ করেছিলেন ২৫টি। এবং, সব বুথ-ফেরত সমীক্ষাই বলছিল,  মহারাষ্ট্র ও হরিয়ানায় ঝড় তুলবে বিজেপি। উল্টো দিকে টিম টিম করে জ্বলছে কংগ্রেস। লোকসভায় হারের দায় নিয়ে সভাপতি পদ থেকে ইস্তফা দিয়েছেন রাহুল গান্ধী। সোনিয়া হাল ধরেছেন বটে,  কিন্তু দলে নবীন-প্রবীণ কোন্দল তুঙ্গে। তার উপরে মোদি-অমিত শাহের দাপটে,  কুঁকড়ে গিয়েছে দল। সোনিয়া,  প্রিয়ঙ্কা তো প্রচারেই গেলেন না। কোনওরকমে প্রচার সেরেছেন রাহুল। তারপরও প্রত্যাশার চেয়ে ভালো ফল করেছে কংগ্রেস। এই ফলাফলের পর প্রশ্ন একটাই, মহারাষ্ট্র-হরিয়ানার ভোট কি দিলীপ ঘোষদের রক্তচাপ বাড়িয়ে দিল? মহারাষ্ট্র এবং হরিয়ানার বিধানসভা ভোটের ফলের পর পশ্চিমবঙ্গেও বিজেপির ভবিতব্য নিয়ে প্রশ্ন উঠতে শুরু করল। লোকসভা ভোটে এরাজ্যে ১৮টি আসন জিতে চমক দেখিয়েছিল তারা। কিন্তু মহারাষ্ট্র, হরিয়ানার ফলের পর প্রশ্ন উঠছে—২০২১-এ এই রাজ্যের বিধানসভা ভোটে তারা ওই সাফল্যও ধরে রাখতে পারবে তো?