বিদ্যার্থীদের বেশি শ্রম দিয়ে পঠন-পাঠন করা দরকার। কোনও সংস্থায় যুক্ত হলে বিদ্যায় বিস্তৃতি ঘটবে। কর্মপ্রার্থীরা ... বিশদ
বিদ্যাসাগর স্বয়ং ছিলেন সাহস ও স্পর্ধার প্রতীক। তিনি সাহেবের মুখের উপর চটিসুদ্ধ পা টেবিলে তুলে বসার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন পরাধীন ভারতে। সাহেবের অভদ্রতার বিরুদ্ধে। চিরকাল তিনি অত্যন্ত অনমনীয় মানুষ ছিলেন, এবং প্রথা ভাঙার প্রতি তাঁহার বিশেষ উৎসাহ ছিল। যে-যুগে ধর্ম বাদ দিয়ে নীতিশিক্ষার কথা ভাবা যেত না, সেই যুগে তিনি ধর্ম-প্রভাব বর্জিত ‘বর্ণপরিচয়’ লিখে নীতিশিক্ষা দিয়েছেন। সমাজের প্রচলিত মত ও প্রথার বিরুদ্ধে গিয়ে মেয়েদের বিদ্যালয়ে পাঠানোর ব্যবস্থা করেছেন। বিধবাদের বিবাহের বন্দোবস্ত করেছেন। সংস্কৃতে অত বড় পণ্ডিত হয়েও আহ্নিক করতেন না। বলতেন, সন্ধ্যামন্ত্র ভুলে গিয়েছেন। তাঁর স্মরণসভায় রবীন্দ্রনাথ তাঁর চরিত্রের এই দিকটির প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেছিলেন, ‘‘আমাদের দেশের লোকেরা এক দিক দিয়ে তাঁকে শ্রদ্ধাজ্ঞাপন না করে থাকতে পারেননি বটে, কিন্তু বিদ্যাসাগর তাঁর চরিত্রের যে মহত্ত্বগুণে দেশাচারের দুর্গ নির্ভয়ে আক্রমণ করতে পেরেছিলেন, সেটাকে কেবলমাত্র তাঁর দয়াদাক্ষিণ্যের খ্যাতি দ্বারা তাঁরা ঢেকে রাখতে চান।’’ বাংলা গদ্যকে ‘সুমধুর’ অথচ গভীর অর্থবহ, প্রাণবন্ত, ‘কলানৈপুণ্যে’ একান্ত স্বাভাবিকভাবেই লালিত করার বিদ্যাবুদ্ধি মানসিকতা-সঞ্জাত শক্তি ছিল বিদ্যাসাগর মহাশয়ের। ভাষাকে নিজেরই মতো শিরদাঁড়াসম্পন্ন করে তোলেন তিনিই। রামায়ণ, কালিদাস, শেক্সপিয়র, ঈশপ্ প্রভৃতি থেকে অনুবাদে নামলেন। বাংলা সংস্কৃতের দুহিতা বলে গর্ববোধ অবশ্যই ছিল, কিন্তু বাংলা ভাষার নিজস্বতাকে মহিমামণ্ডিত করার চেষ্টা থেকে নিবৃত্ত কখনও হননি। সহজবোধ্য নতুন ব্যাকরণ সৃষ্টি হল তাঁর কীর্তি... লেখনীই অস্ত্র হল অধঃপতিত সমাজের উন্নয়নকল্পে; বিধবাবিবাহ প্রচলন, বহুবিবাহ নিবারণ, স্ত্রী-শিক্ষাপ্রোৎসাহন প্রভৃতি বিষয়ে অক্লান্ত তাঁর রচনাপুঞ্জ।... গম্ভীর রচনার জন্য খ্যাত এই বিরাট বিদ্বান একেবারে সহজ সরস ও বিদ্রূপাত্মক প্রবন্ধ লিখতেও নিবৃত্ত হলেন না...।
বিদ্যাসাগরের মূল প্রবণতাটি কখনওই প্রশ্নহীন আনুগত্য নয়, বরং যা চলে আসছে তাকে বারংবার যাচাই করা, এবং পছন্দ না হলে তাকে অস্বীকার করা, এমনকী আঘাত করা। যাঁরা তাঁর নিন্দেমন্দ করতেন, বিদ্যাসাগর তাঁদের সকৌতুকে জিজ্ঞাসা করতেন, কী উপকার তিনি করেছিলেন যে এত বিদ্বেষ তাঁর প্রতি? এমন আর একজন মানুষেরও দৃষ্টান্ত মেলে না, জনকল্যাণে নিবেদিত হওয়ার জন্য যিনি এত প্রশংসা পেয়েছিলেন, আবার যাঁর এত দুর্নামও করা হয়েছে। যেসব গোষ্ঠী বিদ্যাসাগরকে নিজের দলে টানতে চেয়েছিল, তিনি কোনও দিনই সেখানে নাম লেখাননি? একটা সময়ে তিনি তাঁর নিজের গ্রাম বীরসিংহ ছেড়ে দিয়েছিলেন। সমসাময়িক তরুণদের সঙ্গে যোগ দিয়ে দেশপ্রেমী সংগঠন গড়ে তোলার আহ্বান তিনি প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। তিনি জানতেন, এর ফলে আরও আঘাত আসবে। অভিমানে ক্ষতবিক্ষত একজন আমহার্স্ট স্ট্রিটের ৬৩ নম্বর বাড়িতে দোতলার একটি ঘরে বসে নিজের হাতে লিখছেন তাঁর ইচ্ছাপত্র বা উইল। লিখেছিলেন, ‘‘আমার পুত্র বলিয়া পরিচিত শ্রীযুক্ত নারায়ণ বন্দ্যোপাধ্যায় যারপরনাই যথেচ্ছাচারী ও কুপথগামী এজন্য, ও অন্য অন্য গুরুতর কারণবশতঃ আমি তাহার সংশ্রব ও সম্পর্ক পরিত্যাগ করিয়াছি।’’ তাঁকে শুধু তাঁর একমাত্র পুত্র বা পরিবার আহত করেনি, তাঁকে রক্তাক্ত করেছে তথাকথিত শিক্ষিত সমাজ, ইংরেজ শাসক, সেই শাসকদের করুণা-লোভী জমিদার শ্রেণি বাবু সম্প্রদায়। ছেলেকে করেছেন ত্যাজ্য। বাবা কাশীবাসী। মা সেখানেই কলেরায় মারা গিয়েছেন। বিদ্যাসাগরের শেষ জীবন এরকমই। তাঁর জন্মের দ্বিশতবর্ষে গবেষক ও চরিতকারদের কত মূল্যায়ন। তাঁর অজেয় মনুষ্যত্ব, শেষ দিনগুলির নিঃসঙ্গতা, বিজ্ঞানমনস্কতা। আবার বিদ্যাসাগর ও তৎকালীন বঙ্গসমাজে তাঁর সঙ্গে বিভিন্ন ব্যক্তিত্বের পারস্পরিক সম্পর্ক। সামাজিক আন্দোলন ও বিদ্যালয় স্থাপনে বিদ্যাসাগরের সক্রিয় ও অগ্রণী ভূমিকা। প্রতিবেশী সাহিত্য ও সমাজেও বিদ্যাসাগরের প্রভাব। বছরভর বিদ্যাসাগরকে নিয়ে নানা রচনা, আলোচনা নিয়ে ব্যস্ত থাকবেন সারস্বত সমাজের মানুষজন। তবুও বলতে হয়, দ্বিশতজন্মবর্ষে তাঁকে নিয়ে নতুন করে চর্চা শুরু হয়েছে, সুলক্ষণ! জন্ম দ্বিশতবর্ষে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরকে নিয়ে বই ছাপছে শিক্ষা দপ্তর। কোনও মনীষীকে নিয়ে এই প্রথম বই প্রকাশ করছে রাজ্য সরকার। স্কুল-কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ুয়াদের হাতে এই বই তুলে দিতে চায় সরকার। আসুন, আমরা আপাতত তাঁর লেখা পড়ি। বাংলাভাষাকে একটু জানার চেষ্টা করি। বিদ্যাসাগরের জন্মের দ্বিশতবর্ষে এই হোক আমাদের কাজ।