অসমের জন্য প্রথম এনআরসি লিস্ট প্রকাশ করা হয় ১৯৫২ সালে। সেই তালিকার হালফিল চেহারাটা কী, তা জানার জন্য ২০১৩ সালে সুপ্রিম কোর্টের তত্ত্বাবধানে নতুন করে প্রক্রিয়া শুরু হয়। বিপুল সংখ্যক কর্মী নামিয়ে এবং বিপুল অর্থে এই দুরূহ কাজটি শেষ করার লক্ষ্য স্থির করা হয়। প্রথম খসড়া তালিকা প্রকাশিত হয় ২০১৮ সালের ৩০ জুলাই। অসমের জনসংখ্যা ৩ কোটি ৩০ লক্ষের মতো। খসড়া তালিকায় ৪০ লক্ষাধিক নারীপুরুষের নাম বাদ পড়ে যায়। পরে একটি অতিরিক্ত খসড়া তালিকাও বেরয়। তাতে বাদে পড়ে আরও প্রায় এক লক্ষ নাম। এ নিয়ে শুধু অসমে নয়, সারা দেশে, এমনকী বাংলাদেশেও সোরগোল পড়ে যায়। ভারতে বিজেপি-বিরোধী বেশিরভাগ দল এনআরসি নিয়ে সরকারের অতি সক্রিয়তার বিরুদ্ধে সরব হয়। তাদের অভিযোগ, সম্পূর্ণ ভুল নীতি, পদ্ধতি ও তথ্যের ভিত্তিতে এই তালিকা প্রস্তুত করা হয়েছে। তাই বহু প্রকৃত ভারতীয় নাগরিকের নাম পড়ে গিয়েছে। সবচেয়ে বেশি বাদ দেওয়া হয়েছে বাংলাভাষীদের নাম। বিশেষ করে তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মোদি সরকারের এই উদ্যোগের তীব্র নিন্দা করেন। তাঁর আশঙ্কা, এর মধ্যে সঙ্কীর্ণ রাজনীতি, বাঙালি-বিদ্বেষ এবং সম্প্রদায়গত বিরোধের বীজ সুপ্ত আছে। তাই এই আগুন নিয়ে খেলা থামানোর দাবি জানান তিনি। স্বভাবতই গত লোকসভার ভোটের প্রচারেও প্রভাব ফেলে এনআরসি বিতর্ক। সরকার অবশ্য দাবি করে, প্রকৃত ভারতীয় নাগরিকদের কোনও ভয় নেই। তখন সরকার আশ্বস্ত করে যে খসড়া তালিকাই চূড়ান্ত নয়। যাঁদের নাম বাদ পড়ল উপযুক্ত প্রমাণসহ তাঁরা ফের আবেদন করতে পারবেন। কর্তৃপক্ষ সেসব খতিয়ে দেখেই চূড়ান্ত তালিকা তৈরি করবেন।
সেই চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশিত হল ৩১ আগস্ট, শনিবার। তাতে দেখা যাচ্ছে, ১৯ লক্ষাধিক নাম বাদ পড়েছে। অভিযোগ, চূড়ান্ত তালিকায় এমন বহু পরিবারের নাম বাদ পড়েছে যারা ৪০-৫০ বছর যাবৎ কিংবা আরও বেশিদিন অসমে বসবাস করছে। সেসব পরিবারের কর্তারা অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মী কিংবা দীর্ঘকাল যাবৎ এদেশে তাঁদের ঘরবাড়ি চাষ-আবাদ ব্যবসা-বাণিজ্য রয়েছে। আবার এমনও হয়েছে—স্বামীর নাম আছে কিন্তু স্ত্রীর নাম নেই কিংবা পুত্র-কন্যার নাম আছে তো বাবা-মায়ের নাম নেই! সোজা কথায়, চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশের পর সরকারের পুরনো আশ্বাস বস্তুত নস্যাৎ হয়ে গিয়েছে। এই হতভাগ্যদের সামনে শেষ সুযোগ—আগামী চারমাসের মধ্যে ফরেনার্স ট্রাইব্যুনালে আবেদন। তাঁদের কাছে যেসব গ্রাহ্য নথি আছে সেগুলি তাঁরা শুনানির সময় পেশ করবেন। কিন্তু যতদিন-না ফয়সালা হয়, ততদিন এঁদেরকে সন্দেহভাজন হিসেবেই কাটাতে হবে। নিজের দেশের মানুষের সামনে এই জ্বালা ও অপমান কি তাঁদের প্রাপ্য? এঁদের পরিবারের কত গুরুত্বপূর্ণ প্রয়োজন লণ্ডভণ্ড হয়ে যেতে পারে—চিকিৎসা, বিয়ে, শিক্ষা, চাকরি, ব্যবসা, জমি-বাড়ি কেনাবেচা ... অসংখ্য প্রয়োজন। এটাও মনে রাখা দরকার, বহু পুরনো নাগরিক হওয়া সত্ত্বেও সকলের কাছে গ্রাহ্য নথি নাও থাকতে পারে। এর একটি কারণ শিক্ষা ও চেতনার অভাব। অন্য কারণ বন্যা ভূমিকম্প মতো প্রাকৃতিক বিপর্যয় কিংবা দাঙ্গা ও আগুনের মতো দুর্ভাগ্য।
চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশের পরও এনআরসি নিয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পুরনো অবস্থানের বদল হয়নি। প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে তিনি শনিবার বলেছিলেন, এনআরসি ইস্যুতে যারা রাজনীতি করার চেষ্টা করছেন তাঁদের মুখোশ খুলে গিয়েছে। অসৎ উদ্দেশ্যে কোনও আইন আনা হলে এরকমই হয়। রবিরার তিনি অভিযোগ করেছেন, হাজার হাজার প্রকৃত ভারতীয়ের নাম বাদ গিয়েছে। তাঁদের মধ্যে রয়েছে সিআরপিএফ এবং অন্য জওয়ানদেরও নাম! দেশের প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি ফকরুদ্দিন আলি আহমেদের পরিবারের সদস্যদের নামও বাদ গিয়েছে! সুখের কথা এই, অসমের বিজেপি সরকারের অর্থমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্বশর্মাও এবার বেসুরো গেয়েছেন। এনআরসির এতদিনের কট্টর এই সমর্থক শনিবার বলেছেন, এই তালিকা অসমের লক্ষ্যপূরণে সহায়ক হবে না। একদিকে বহু প্রকৃত নাগরিকের নাম বাদ গিয়েছে, অন্যদিকে বহু অনুপ্রবেশকারীর নাম ঢুকেছে। এই তালিকা তৈরি নিয়ে দুর্নীতির অভিযোগটি খোদ বিজেপির!
সরকারের উচিত, যুক্তিপূর্ণ আচরণ করা। দেশ আর্থিক দিক থেকে
ক্রমশ খুব খারাপ জায়গায় চলে যাচ্ছে। দেশের অর্থনীতি চাঙ্গা করাই মূল লক্ষ্য হওয়া দরকার। বিদেশি বিতাড়নের হুজুগ তুলে দেশেরই একাংশ মানুষকে বিপদে ফেলে সেই কাজ অসম্ভব। দেশের মানুষ যাতে আরও নির্ভয়ে নিশ্চিন্তে আনন্দের সঙ্গে দেশ গড়ার কাজে আত্মনিয়োগ করতে পারেন, সেই পরিবেশ রচনা করাই হোক সরকারের প্রধান কর্মসূচি।