অর্থনীতিতে সঙ্কটের নয়া অধ্যায়। কেন্দ্রীয় পরিসংখ্যান দপ্তর জানিয়ে দিয়েছে, চলতি আর্থিক বর্ষের প্রথম ত্রৈমাসিকে আর্থিক বৃদ্ধির হার নেমে গিয়েছে ৫ শতাংশে। তার আগের ত্রৈমাসিকে যা ছিল ৫.৮ শতাংশ। অথচ, ২০১৮ সালের ৩০ জুন শেষ হওয়া ত্রৈমাসিকে আর্থিক বৃদ্ধির হার ছিল ৮ শতাংশ। পরিসংখ্যানেই স্পষ্ট, দেশের অর্থনীতি আজ মোটেই খুব একটা ভালো জায়গায় নেই। ২০১৩ সালের মার্চ মাসের পর এত খারাপ অবস্থায় অর্থনীতি যায়নি। এই পরিস্থিতিতে স্বভাবতই কপালের ভাঁজ বেড়েছে কেন্দ্রীয় সরকারের। ধাক্কা খেতে শুরু করেছে শেয়ার বাজার। প্রশ্ন হল, কেন এই সঙ্কট? প্রধান কারণ অবশ্যই, বাজারে চাহিদার ঘাটতি। যাকে বলা হয় কনজিউমার ডিমান্ড। অর্থনীতির ভিতটাই নির্ভর করে ডিমান্ড এবং সাপ্লাইয়ের উপর। যে পণ্যের চাহিদা বাড়বে, সেই অনুযায়ী মার্কেট তথা প্রস্তুতকারক সংস্থাগুলি তা সরবরাহ করবে। বাজারে নগদের জোগান কমে যাওয়ায় খুব স্বাভাবিকভাবেই সাধারণ মানুষের ক্রয় ক্ষমতাও কমছে। ফলে চাহিদা তৈরি হচ্ছে না। এটা যে কোনও পণ্যের ক্ষেত্রেই সত্যি। একদিকে তা বিস্কুট যেমন হতে পারে, অন্যদিকে হতে পারে গাড়িও। ঠিকই সেই পরিস্থিতিই তৈরি হয়েছে। অটোমোবাইল শিল্পে প্রাইভেট গাড়ি বিক্রি কমেছে ৩১ শতাংশ। যে হার গত ১৯ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন। এর ফলে নামজাদা গাড়ি প্রস্তুতকারক কিছু কোম্পানি উৎপাদন বন্ধ করে কর্মীদের অনির্দিষ্টকালের জন্য ছুটিতে যেতে বলেছে। একই রকম সঙ্কট দেখা দিয়েছে একটি বিস্কুট প্রস্তুতকারক সংস্থার ক্ষেত্রেও। সেই সংস্থা একসঙ্গে ১০ হাজার কর্মী ছাঁটাই করেছে। এই দু’টি উদাহরণ মাত্র। একের পর এক বড় সংস্থা লোকসান ঠেকাতে কর্মী ছাঁটাই এবং উৎপাদন বন্ধের দিকে যাচ্ছে। বাজারে যদি পণ্যের চাহিদাই না থাকে, তাহলে উৎপাদন করে লাভ কী? আর উৎপাদন বন্ধ রাখা মানে একদিকে যেমন ঠিকাকর্মী বা অস্থায়ী কর্মীদের টাকা দিতে হবে না, পাশাপাশি পণ্য প্রস্তুতের আনুষঙ্গিক খরচও কমে যাবে। এর সরাসরি প্রভাবটা পড়ছে বিনিয়োগে। বেসরকারি বহু সংস্থা লগ্নি বন্ধ করে দিয়েছে। ফলে নতুন করে কর্মসংস্থান তৈরি হচ্ছে না। বাড়ছে বেকারত্ব।
অর্থনীতির এমন এক একটি ক্ষেত্র অন্যগুলির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। চাহিদা কমলে বিনিয়োগ হবে না। তাই এই মুহূর্তে পরিকাঠামো খাতে ব্যয় বরাদ্দ বাড়ানো ছাড়া প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির কাছে করার কিছু নেই। আপাতত সেই পথেই চলতে শুরু করেছে সরকার। রিজার্ভ ব্যাঙ্কের উদ্বৃত্ত অর্থ ইতিমধ্যেই সরকারি কোষাগারে ভরে ফেলার প্রক্রিয়া শুরু হয়ে গিয়েছে। মনে করা হচ্ছে, পরিকাঠামোগত উন্নয়নের কাজেই এই অর্থ ব্যবহার করবে সরকার। পাশাপাশি বাজারে নগদের জোগান বাড়ানো হচ্ছে। এই সবই দেশের বাজার রক্ষা করার দাওয়াই।
আরও একটি ওষুধ কেন্দ্রীয় সরকার প্রেসিক্রিপশনে লিখেছে। ১০টি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের সংযুক্তিকরণ। যার মধ্যে রয়েছে এলাহাবাদ ব্যাঙ্ক, ইন্ডিয়ান ব্যাঙ্ক, পিএনবিও। এই সিদ্ধান্তের পর দেশের রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের সংখ্যা ২৭টি থেকে কমে হল ১২টি। এটি অবশ্যই একটি সাহসী সিদ্ধান্ত। আর্থিক সংস্কারের পথে নরেন্দ্র মোদির আর একটি মাস্টারস্ট্রোক। একদিকে এর ফলে যেমন গোটা ব্যাঙ্কিং সেক্টরটিকে অনেক বেশি একত্রিত করা গেল, তেমনই এর ফলে পরিকাঠামোগত খরচও কমবে। কেন্দ্র উল্টো দাবি করলেও এর পাশাপাশি কর্মীসংকোচনও হবে। সাধারণ মানুষের এতে হয়তো কিছুই আসে যায় না। কিন্তু আর্থিক পরিস্থিতির ডুবন্ত নৌকার হাল ধরতে এই ধরনের পদক্ষেপ ছাড়া নরেন্দ্র মোদির সামনে তেমন কোনও উপায় নেই। দেশটাই যে চলছে গ্রাহকের সৌজন্যে! ক্রেতার হাতে টাকার জোগান যেভাবে হোক বাড়াতে হবে। সেটা হল না, অথচ বাজার অগ্নিমূল্য হয়ে গেল, তাতে আদপে ভোটের বাজারে ভুগতে হবে কেন্দ্রীয় সরকার তথা বিজেপিকে। তাই আপাতত বাজার চাঙ্গা করাই নরেন্দ্র মোদির প্রাথমিক লক্ষ্য। যে যুব প্রজন্ম তাঁকে ঢেলে ভোট দিয়েছে, তাদের জন্য কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা কিন্তু করতেই হবে।