ছ’বছর আগের কথা। বিজেপি তখন রাজ্যে মাথা চাড়া দিয়ে ওঠেনি। তারা তখন নেহাতই নগণ্য এক শক্তি। এ রাজ্যে তাদের নিয়ে বড় একটা চিন্তিত ছিল না শাসক দল। সকলের অলক্ষে বিজেপি টার্গেট করেছিল একদা বামদুর্গ জঙ্গলমহলকেই। বাম জমানায় যারা এলাকায় ‘হার্মাদ’ বলে পরিচিত হয়ে উঠেছিল, নীতি-আদর্শকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে সেই হার্মাদদের আশ্রয়স্থল হয়ে উঠেছিল গেরুয়া শিবির। সিপিএম নেতাদেরও হাবভাবটা ছিল, আপাতত তৃণমূলকে হটানোর ‘পবিত্র’ কাজটা বিজেপি করে দিক। তারপর যথাসময়ে সম্প্রীতির সাচ্চা দূত হয়ে আমরা মঞ্চে পুনরায় অবতীর্ণ হব। সিপিএম নেতৃত্বের ধারণা ছিল, যেভাবে তাঁদের কমরেডরা দল বেঁধে বিজেপির প্রতীক গ্রহণ করেছেন, পঞ্চায়েত ভোটের পর সেইভাবেই ঝাঁকের কইয়ের মতো তাঁরা পুরনো দলে ফিরে আসবেন। ২০১৩-র সেই পঞ্চায়েত ভোটে পদ্মবেশী কমিউনিস্টরা অঞ্চল দখল করতে পারেননি। কিন্তু, এখন সেই পঞ্চায়েত বিজেপির নিরঙ্কুশ কব্জায়। সিপিএমের ফাঁকা জায়গায় জাঁকিয়ে বসেছে বিজেপি। সিপিএমের স্থানীয় নেতৃত্বও মানছেন, যাঁরা এখন ওখানে বিজেপি করছেন, তাঁদের ৬০ শতাংশেরও বেশি সিপিএমের ঘর ভেঙে বেরনো। সিপিএম থেকে প্রস্থান হয়েছিল পরিকল্পিতভাবে,কিন্তু একই পরিকল্পনামাফিক বিজেপি থেকে সিপিএমে ‘ঘর ওয়াপসি’ একেবারেই হয়নি। একসময়ের হার্মাদদের কাছে আজ মূল্যহীন বাম আদর্শের কচকচি ও নীতির ভাষণ। হবেই-বা না কেন? যে-পার্টি নিজেদের কমরেডদের আশ্রয় দিতে পারেনি, ভরসা জোগাতে পারিনি, তারা কেন সিপিএমের সঙ্গে থাকবেন? এই তথ্য নিশ্চিত জানেন আলিমুদ্দিন স্ট্রিটের মাতব্বররা। একটা গোটা হাড়ির ভাত সেদ্ধ হয়েছে কি না, তা জানতে কয়েকটা ভাত টিপে দেখাই যথেষ্ট। জঙ্গলমহলের এই অঙ্কই রাতারাতি ছড়িয়ে পড়ে গোটা রাজ্যে। জঙ্গলমহল থেকে কোচবিহার। গত পঞ্চায়েত নির্বাচন থেকেই বাংলায় শক্তি বাড়িয়েছিল বিজেপি। তৃণমূলের দাপট সত্ত্বেও বেশ কয়েকটি জেলায় ফুটেছিল পদ্মফুল। তারপর থেকে রাজ্য রাজনীতিতে কোণঠাসা বামপন্থীরা ক্রমশ প্রান্তিক শক্তিতে পরিণত হতে শুরু করে। আর ভোটবাক্স ভরতে থাকে বিজেপির। বিজেপির যে সংগঠনকে খেলনা সংগঠন বলে মনে করেছিল আলিমুদ্দিন স্ট্রিটের মাতব্বররা, তারাই প্রকৃত বিরোধী শক্তি হয়ে উঠল গোটা রাজ্যে। আর, ভঙ্গুর, আরও ভঙ্গুর হল কমিউনিস্টরাই। এতে বিজেপির দোষ কোথায়?
ফলে বিপর্যয়ের আশঙ্কা ছিলই। কিন্তু তার অভিঘাত যে এমন হবে, ভাবতে পারেননি বঙ্গের বাম নেতারা। বাম-রাম একসঙ্গে কাজ করেছে বাংলায়, একাধিক মঞ্চে অভিযোগ করেছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। পাত্তা দেয়নি আলিমুদ্দিন স্ট্রিটের তাত্ত্বিক মাতব্বররা। এর ফল? একজন ছাড়া পশ্চিমবঙ্গে আর সমস্ত বাম প্রার্থীকেই জামানত বাজেয়াপ্ত হওয়ার লজ্জা পেতে হল ২০১৯ লোকসভা নির্বাচনে। সেই রাজ্য, যেখানে ২০১১ পর্যন্ত টানা ৩৪ বছর রাজত্ব করেছে বামেরাই। একমাত্র যাদবপুর কেন্দ্রের প্রার্থী সিপিএমের বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্য ২১.০৪ শতাংশ ভোট পেয়েছেন। বাকি বামফ্রন্ট প্রার্থীরা কেউই জামানতের ২৫ হাজার টাকা ফেরত পাবার শর্ত হিসেবে ন্যূনতম ১৬.৬ শতাংশ ভোটও পাননি। তথ্য বলছে, ২০১৪ সালে মোট ভোটের ২৯.৭১ শতাংশ ভোট পেয়ে দ্বিতীয় স্থানে ছিল বিমান বসু, সূর্যকান্ত মিশ্রদের দল। এবার সেই হার দাঁড়িয়েছে ৭ শতাংশের আশপাশে। অর্থাৎ, হিসেব বলছে, ভোট কমেছে প্রায় ২৩ শতাংশ। তাহলে বামেদের এত ভোট গেল কোথায়? ছবিটা স্পষ্ট হয়ে যাবে বিজেপির ভোট শেয়ারের দিকে চোখ রাখলে। গত লোকসভা ভোটে ১৭.০২ শতাংশ ভোট পেয়েছিল বিজেপি। সেখানে এবার তাদের দখলে ৪০ শতাংশ ভোট। অর্থাৎ এক ধাক্কায় তাদের ভোট বড়েছে ২৩ শতাংশ। বিজেপির জয়ের পথে অনুঘটকের কাজ করেছে বামেরাই। এই সমালোচনা নিশ্চিত মানবেন না আলিমুদ্দিনের কর্তারা। মানতেও চাননি সূর্যকান্ত মিশ্র। দায় এড়াতে তাঁর অভিযোগ, রাজ্যে রাজনৈতিক মেরুকরণের সঙ্গে ধর্মীয় মেরুকরণও হয়েছে। এই কারণেই নাকি বামেদের ভোটব্যাঙ্কে ভয়াবহ ধস নেমেছে। সূর্যকান্ত মিশ্র যা-ই অঙ্ক নামান না কেন, এখন শুধু দেখার অপেক্ষা—কবে একের পর এক সিপিএমের তাত্ত্বিক গুরুরা গেরুয়া পতাকা হাতে তুলে নিয়ে বলবেন, জয় শ্রী রাম!