যখন যারা সরকারে থাকে তখন তাদের গৃহীত সিদ্ধান্তগুলি দেশের স্বার্থে ও দেশবাসীর কল্যাণে নেওয়া বলেই দাবি করতে থাকে। বহু মানুষ তা বিশ্বাসও করেন। নোটবন্দি হল নরেন্দ্র মোদি সরকারের নেওয়া এমনই একটি সিদ্ধান্ত। নোটবন্দির কারণে দেশ ও দেশের মানুষের কতটা কী লাভ হয়েছে তা নিয়ে বিতর্কের অবকাশ রয়েছে। তবে, নোটবন্দির সুফল ব্যাখ্যা করে সরকার পক্ষ থেকে যেসব যুক্তি দেওয়া হয়েছিল তার অনেকগুলিই যে খাটেনি তা অকপটে স্বীকার করে নেওয়াই বোধহয় ভালো। যেমন ধরা যাক, নোটবন্দির কারণ হিসেবে কালো টাকা, জাল নোট বা জঙ্গিদের হাতে ভারতীয় টাকা ঘোরাফেরা বন্ধ করার কথা বলা হয়েছিল। বাস্তবে দেশবাসী দেখলেন জাল নোটের রমরমা, কালো টাকা উদ্ধার তো হয়ইনি বরং রিজার্ভ ব্যাঙ্কের হাতে বাতিল হওয়া পুরনো অধিকাংশ ৫০০ ও ১০০০ টাকার নোট ফেরত গিয়েছিল। ফলে, সেক্ষেত্রে অন্তত কালো টাকার হিসেব খাটে না। জঙ্গিদের হাতে যে যথেষ্ট পরিমাণ ভারতীয় টাকা রয়েছে তা দেশে জঙ্গিহানা বা তাদের তৎপরতা থেকেই স্পষ্ট। প্রশ্ন উঠতেই পারে, মোদি সরকারের নোটবন্দির সিদ্ধান্তে কী পেলেন ভারতবাসী? উত্তর হতেই পারে দুর্ভোগ এবং ক্ষুদ্র ও মাঝারি বেশকিছু শিল্প বন্ধ হওয়ার কারণে বহু মানুষের কাজ হারানো। নোটবন্দির কারণে ভারতীয় অর্থনীতি কতটা চাঙ্গা হয়েছে তা বিচার করবেন দেশের অর্থনীতিবিদরা। তবে, ভারতীয় অর্থনীতিতে যে এর কুপ্রভাব পড়েছে বলে বিরোধীদের তোলা অভিযোগটি একেবারেই উড়িয়ে দেওয়ার মতো নয়।
২০১৬ সালের ৮ নভেম্বর হঠাৎ করেই মোদি সরকার নোটবন্দির সিদ্ধান্ত ঘোষণা করে। কেন্দ্রের ওই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বেশি সরব হন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর তোলা অভিযোগগুলি যে একেবারেই অমূলক ছিল না, সে প্রমাণও মিলেছে। স্বৈরাচারী ও হঠকারী বলে কেন্দ্রের সিদ্ধান্তটিকে ব্যাখ্যা করে বিরোধী দলগুলিও নোটবন্দির সমালোচনায় মুখর হয়। নোটবন্দির পর গত দু-আড়াই বছর ধরে গঙ্গা দিয়ে অনেক জল বয়ে গিয়েছে। রিজার্ভ ব্যাঙ্কের তৎকালীন গভর্নর উর্জিত প্যাটেলও পদত্যাগ করেছেন। অভিযোগ উঠেছিল, সকলকে অন্ধকারে রেখেই মোদি সরকার এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিয়ে সাধারণ মানুষকে বিপাকে ফেলেছে। মোদি সরকার যে সত্যিই নোটবন্দির প্রশ্নে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়ার বক্তব্যে বিশেষ আমল দেয়নি সেই সত্যটিও প্রকাশ হয়ে পড়ল এতদিন পর। কী সেই সত্য? আরটিআইয়ের মাধ্যমে হাতে পাওয়া একটি তথ্য বলছে, তৎকালীন গভর্নর উর্জিত প্যাটেলের সভাপতিত্বে ২০১৬ সালের ৮ নভেম্বর বিকেল সাড়ে ৫টায় নয়া দিল্লিতে রিজার্ভ ব্যাঙ্কের সেন্ট্রাল বোর্ড অব ডিরেক্টরদের ৫৬১ তম বৈঠক বসে। যেখানে বলা হয়, নোটবন্দির ইস্যু জিডিপিতে প্রভাব ফেলবে এবং অসুবিধায় পড়বেন বিদেশ থেকে ভারতে আসা মানুষজন। কারণ, তাঁরা সাধারণত বড় অঙ্কের নোটই সঙ্গে রাখেন। ওই বোর্ড মিটিংয়ে কালো টাকার প্রসঙ্গটিও আলোচনায় ওঠে। যেখানে বলা হয়, কালো টাকা নগদে রাখার চেয়ে জায়গাজমি, সোনা কেনা বা রিয়েল এস্টেটে রাখা হয়। অর্থাৎ বোঝাই যাচ্ছে, নোটবন্দির পক্ষে প্রধানমন্ত্রী যেসব যুক্তি দেখিয়েছিলেন তার সঙ্গে একমত ছিল না আরবিআই। এও স্পষ্ট হয়েছে, আরবিআইয়ের যুক্তিকে তোয়াক্কা না-করেই নোটবন্দির সিদ্ধান্তটি নেওয়া হয়েছিল। ২০১৬ সালের ৮ নভেম্বরের নোটবন্দির ঘোষণার মাত্র আড়াই ঘণ্টা আগের আরবিআইয়ের বৈঠকের আলোচনাটি সরকারের কাছে আদৌ গুরুত্বপূর্ণ ছিল কি না সে নিয়ে প্রশ্ন ওঠাই স্বাভাবিক। তাই, নোটবন্দি প্রসঙ্গে আরটিআইয়ের মাধ্যমে পাওয়া আরবিআইয়ের বক্তব্য বিষয়ক নয়া তথ্যটি বিরোধীদের কাছে মোদি-বিরোধী সুর চড়াতে সহায়ক হবে। বোঝাই যাচ্ছে, লোকসভা নির্বাচনে নোটবন্দি ইস্যুটি মোদি সরকারের পিছু কিছুতেই ছাড়বে না।
একথা ঠিক, এমন গুরুত্বপূর্ণ একটি সিদ্ধান্ত যে নিতে যাচ্ছে সরকার বিরোধীরা তা বিন্দুমাত্র আঁচ করতে পারেনি। অথচ, নোটবন্দি ঘোষণার ঠিক আগে আগে কিন্তু রাজ্যে রাজ্যে বিজেপির দপ্তর খোলার জন্য জমি কেনা হয়েছিল বলে অভিযোগ উঠেছিল। একটি সমবায় ব্যাঙ্কে ৫০০ কোটি টাকা জমাও পড়েছিল বলে অভিযোগ। এই সবকিছুকেই লোকসভা নির্বাচনে মোদি-বিরোধী প্রচারের হাতিয়ার করবে বিরোধীরা। সরকারের যে-সিদ্ধান্তের জন্য মানুষকে এত দুর্ভোগ সইতে হয়েছে সেই নোটবন্দি ইস্যুটিকে হাতিয়ার করতে আরটিআইয়ের নয়া তথ্যটি বিরোধীদের হাতে অতিরিক্ত একটি সুযোগ এনে দিল।