‘হে বঙ্গ ভাণ্ডারে তব বিবিধ রতন’...কবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত বহুকাল আগেই রত্নগর্ভা বাংলাদেশকে এই বলেই সম্বোধন করেছিলেন। একেবারে ঠিক উপলব্ধি। আবার ‘ভারতরত্ন’ সম্মানে ভূষিত হলেন আরও একজন বাঙালি। যিনি আবার প্রাক্তন রাষ্ট্রপতিও। এবার তিন ভারতরত্ন প্রাপকদের মধ্যে প্রণববাবু বাংলারই সন্তান। প্রবীণ রাজনীতিবিদ, যাঁর স্থিতধী, প্রজ্ঞা, বিচক্ষণতা, কূটনীতিজ্ঞ বুদ্ধির জন্য অনেকেই তাঁকে দেশের ‘চাণক্য’ বলেও মানেন। দীর্ঘদিন ধরে কংগ্রেস ও কেন্দ্রীয় সরকারের গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী হিসেবে কাজ করার অভিজ্ঞতার দরুণ সব দলের কাছেই তিনি সমান গ্রহণযোগ্যতা ও সম্মান আদায় করে নিয়েছেন। তাঁকে ‘ভারতরত্ন’ সম্মানে ভূষিত করায় সেই কথাই আবার প্রমাণ করে দিল।
২০১২ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব সামলেছেন বঙ্গসন্তান প্রণব মুখোপাধ্যায়। প্রথম বাঙালি রাষ্ট্রপতিও তিনিই। ‘ভারতরত্ন’ প্রণব মুখোপাধ্যায় সম্পর্কে বলতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ট্যুইট করে বলেছেন, ‘আমাদের সময়ের অন্যতম ব্যতিক্রমী নেতা প্রণববাবু। দেশের জন্য তিনি স্বার্থহীন এবং অক্লান্তভাবে কাজ করে গিয়েছেন। দেশের অগ্রগতিতে তাঁর ভূমিকা যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। তাঁর জ্ঞান এবং বুদ্ধিমত্তার কোনও তুলনা হয় না। উনি এই সম্মানে ভূষিত হয়েছেন, এটা অত্যন্ত আনন্দের।’ প্রণববাবুর নিজের প্রতিক্রিয়া, ‘আমি যে এই সম্মান পাচ্ছি, তার কৃতিত্ব আমার দেশবাসীর। আমি সবসময়ই বলে এসেছি, দেশকে আমি যা দিয়েছি, তার থেকে অনেক বেশি ফেরত পেয়েছি।’
শুধু প্রণববাবু একাই নন, এর আগেও ভারতরত্ন সম্মানে ভূষিত হয়েছেন কয়েকজন বিশিষ্ট বাঙালি। বাঙালি ‘ভারতরত্ন’ হিসেবে একই সারিতে রয়েছেন, নয়া পশ্চিমবঙ্গের ‘রূপকার’ বিধানচন্দ্র রায়, স্বাধীনতা সংগ্রামী তথা সমাজসেবী অরুণা (গাঙ্গুলি) আসফ আলি, সেতার বাদক রবিশঙ্কর, পরিচালক সত্যজিৎ রায় ও অর্থনীতিতে নোবেলজয়ী অমর্ত্য সেন। ভারতরত্ন পাননি এমন প্রথিতযশা বাঙালির তালিকা আরও দীর্ঘতর। দেশ ও দশের জন্য যাঁদের অবদানের কাছে ভারতরত্ন সম্মান নেহাতই তুচ্ছ। ভারতের ইতিহাসে বাঙালি ও বাংলার অবদান নিয়ে মোটা মোটা গ্রন্থ লিখেও শেষ করা যাবে না। তাও সম্মান যেহেতু একটা স্বীকৃতি, তাই তার মূল্যও কোনও অংশে কম নয়। সে কারণে প্রণববাবুকে নিয়ে আমাদের গর্ব ও অহংকারের শেষ নেই।
যে কোনও পুরস্কার ও দেশের সর্বোচ্চ অসামরিক সম্মান নিয়ে বিতর্কেরও অবকাশ কম নেই। বহুবারই ‘ভারতরত্ন’ নিয়েও বিতর্কের ঝড় উঠেছে এদেশেও। সাধারণত কেন্দ্রে যে সরকার ক্ষমতায় থাকে, তাদেরই পছন্দের কোনও মানুষের কণ্ঠহারে ভারতরত্ন পরিয়ে দেওয়া হয়। এর নেপথ্যে যে একটা প্রছন্ন রাজনৈতিক স্রোত থাকে না, এমনটা বলা যায় না। কিন্তু, বিজেপি’র চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী কংগ্রেসের প্রবীণ নেতা প্রণব মুখোপাধ্যায়কে এই সম্মান দেওয়া নিয়ে দেশের মানুষ সম্ভবত এই প্রথমবার চমকে উঠেছেন। যৎপরোনাস্তি অবাক হয়েছেন! গত বছরের ৭ জুন নাগপুরে আরএসএসের এক অনুষ্ঠানে সঙ্ঘের সদর দপ্তরে প্রধান অতিথি হিসেবে প্রণববাবুর উপস্থিতি নিয়ে রাজনৈতিক বিতর্ক তৈরি হয়েছিল। কংগ্রেস বিষয়টি নিয়ে দলীয় বিবৃতি না দিলেও, কিছু নেতার মন্তব্য স্পষ্ট করে দিয়েছিল, এতে মোটেই খুশি নয় হাইকমান্ড। যদিও সেসময় এক কেন্দ্রীয় মন্ত্রী বলেছিলেন, ‘এটা একটা সূচনা।’ সম্ভবত সেই সূচনারই ফল এই যে, ভোটের মুখে বিজেপি’র বাঙালি প্রীতিকে হঠাৎ জাগিয়ে তোলার চেষ্টা। কেন এবং কী কারণে তা অতি সাধারণেরও বোধগম্য। ফলে, একটি লাখ টাকা দামের প্রশ্ন ভেসে উঠছেই। আর তা হল, বাঙালির আবেগকে একটু ঝাঁকুনি দিয়ে প্রণববাবুকে ‘ভারতরত্ন’ সম্মানে ভূষিত করা সত্যিই সমাদরের প্রতীক, নাকি মোদি সরকারের কূটকৌশল!